করোনার ভ্যাকসিন : গুজব গুজবই
করোনা টিকাদান কার্যক্রম সম্পর্কে জনসাধারণকে বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি কানাডাভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন, অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন (ক্রীডা) একটি অনলাইনভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ আয়োজনের সারাংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
ডা. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রোজেন ও ডা. আয়শা আকতার
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈশ্বিক করোনা মহামারির ক্রান্তিকালে স্বল্পতম সময়ে করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় এবং বাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ফসল। নিউইয়র্ক টাইমসের ভ্যাকসিনেশন ট্র্যাকার-এর তথ্যানুযায়ী টিকা প্রদানের (মোট ডোজ সংখ্যায়) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম। ইতোমধ্যে সারা দেশে ১৮ লাখেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন এবং ভ্যাকসিন গ্রহণে মানুষের মাঝে আগ্রহ অনেকটা বেড়েছে।
তবে বাংলাদেশকে হার্ড ইমিউনিটি (সামষ্টিক ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা) অর্জন করতে হলে মোট জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন ভুল তথ্য। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, এখনো অনেক মানুষের মাঝে করোনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ভ্যাকসিন বণ্টন সম্পর্কিত নানা আশঙ্কা ও বিভ্রান্তি দৃশ্যমান। করোনার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নানাবিধ গুজব ও ভুল তথ্য বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে ভ্যাকসিন নিতে অনুৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা পরে করোনা সংক্রান্ত মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে ও আমাদের হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ক্রীডার অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, আয়ারল্যান্ডের পোর্টিনকুলা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোসাব্বির হোসাইন, কানাডার আলবার্টা মিনিস্ট্রি অফ হেলথের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং পলিসি বিশ্লেষক ডা. তাহমিদ কাশেম, ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার পলিসি গবেষক ডা. খন্দকার রাইসা সামিহা তাদের গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন (ক্রীডা)-এর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি অ্যাসিস্ট্যান্ট মেহেদী হাসান।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা : করোনার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কিছু উল্লেখযোগ্য ভুল ধারণা হল- যেহেতু স্বল্পসময়ে প্রস্তুত ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাই করোনার ভ্যাকসিন নিরাপদ নয়, ইন্ডিয়া থেকে আমরা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের পরিবর্তে ট্রায়াল ভ্যাকসিন পাচ্ছি। প্রতিবেদন উপস্থাপনার সময় ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার গবেষক খন্দকার রাইসা সামিহা বলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক বাজারজাতকৃত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটি মূলত অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের টেকনোলজি অনুসরণে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউট একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্বনামধন্য টিকা প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান যা বর্তমানে বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ টিকা সরবরাহ করছে এবং প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রস্তুতকৃত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বদ্ধপরিকর। আয়ারল্যান্ডের পোর্টিনকুলা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোসাব্বির হোসাইন উল্লেখ করেন, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক সফল প্রয়োগের পর অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ক্রমে এটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারজাতকরণের অনুমতি পায়। কার্যকারিতা ও গুণগত মান বিচারে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটি ফাইজার ও মডার্না-এর প্রায় সমপর্যায়ের হলেও মূল্যমান এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণজনিত সুরক্ষা বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে অধিক উপযোগী। সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, কোভিশিল্ড টিকার ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটির এক ডোজের কার্যকারিতা ৭৬ শতাংশ, যা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত বজায় থাকে। উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ৮-১২ সপ্তাহ পর দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেশি হয় বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : টিকা গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোসাব্বির হোসাইন বলেন, সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন টিকা গ্রহণের স্থান ফুলে যাওয়া ও ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হতে পারে যা যে কোনো টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমিদ কাশেম বলেন, এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় ১২৮ লাখ ব্যক্তি ফাইজার বা এস্ট্রাজেনেকা টিকার একটি অথবা দুটি ডোজ পেয়েছেন, কিন্তু টিকা সংক্রান্ত কোনো ভয়াবহ জটিলতা, মৃত্যু বা জেনেটিক গঠনগত পরিবর্তনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে মারাত্মক কোনো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, টিকা গ্রহণে মানবদেহের জেনেটিক গঠন পরিবর্তন একটি ভিত্তিহীন গুজব ও ভ্যাকসিনবিরোধী প্রচারণা। সম্প্রতি নরওয়েতে ২৩ জন বয়োবৃদ্ধের কারোরই করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপিয়ান এজেন্সির বিশ্লেষণ এবং রোগীদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পর্যালোচনায় বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
ভ্যাকসিন বণ্টন পরিকল্পনা : জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের মতে, সফলভাবে সারা দেশব্যাপী করোনা টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। প্রথমত, করোনা টিকাদান কর্মসূচি যাতে অন্য নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, করোনা টিকাদান কর্মসূচির সঠিক ট্র্যাকিং ও মনিটরিং-এর জন্য সারা দেশব্যাপী একটি সমন্বিত ডাটাবেস সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা অনায়াসে টিকাদানের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারেন। তৃতীয়ত, ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য জনসচেতনতা ও ভ্যাকসিন বিষয়ে ভীতি দূরীকরণে সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রচার মাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবক, জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সময়মতো ২য় ডোজ নেওয়ার জন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। গণমাধ্যম এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথম পর্যায়ে সবাইকে টিকাদানের আওতায় আনা সম্ভব হবে না মন্তব্য করে ডা. খন্দকার রাইসা সামিহা অভিমত প্রকাশ করেন, সামাজিক দূরত্ব ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা বজায় রাখার ব্যাপারে আরও জোরালো প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট যাতে বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পরে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে কার্যকর হলেও সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা সীমিত।
সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন (ক্রীডা) প্রতিনিধি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পলিসি বিশ্লেষক ডা. তাহমিদ কাশেম মনে করেন, জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই কেবল করোনা টিকাদান কার্যক্রমকে কার্যকরী করতে পারে এবং এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন বিষয়ে সঠিক তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান।
লেখকবৃন্দ : ডা. রোজেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক, কানাডা এবং ডা. আয়শা. ব্যাক্টেরিওলজিস্ট, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ৮-১২ সপ্তাহ পর দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেশি হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে ভ্যাকসিন ভীতির কারণগুলো শনাক্ত করে তা নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি প্রচারমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবক, বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, যুক্তরাজ্য
ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকারীদের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা রয়েছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখে সবাইকে ভ্যাকসিন গ্রহণ ও ভ্যাকসিন কার্ড সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
ডা. মোসাব্বির হোসাইন : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র রেজিস্ট্রার, পোর্টিউনকুলা ইউনিভার্সিটি হসপিটাল, আয়ারল্যান্ড
করোনাভাইরারে নতুন ভ্যারিয়েন্ট যাতে বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পরে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। করোনা ভ্যাকসিনের সর্বাধিক কার্যকারিতার জন্য টিকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনিটরিং এবং দুই ডোজ টিকা গ্রহণ অত্যাবশ্যক; যা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য মোট জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা নিতে হবে, সেক্ষেত্রে ৩০ ভাগ মানুষ টিকা না নিয়েও এর সুফল ভোগ করবে।
ডা. তাহমিদ কাশেম : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কানাডা