মায়েদের প্রসব-পরবর্তী ঘুমের সমস্যা
ডা. সাইফুন নাহার
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রসব-পরবর্তী ঘুমের সমস্যা খুব কমন। অধিকাংশ মায়েদের এ সমস্যা হয়ে থাকে। যাদের বংশে প্রসবের পর ঘুমের সমস্যার ইতিহাস থাকে, পূর্ববর্তী প্রসবের সময় মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে, যাদের নবজাতকের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি থাকে, মায়ের কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা-বেদনা রোগ থাকে, আগে থেকেই কোনো ধরনের মানসিক রোগ থাকে, তাহলে তাদের ঘুমের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
* কেইস হিস্ট্রি-১ : নিতিনা, ২০ বছর বয়স, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে এসেছেন। পাঁচ দিন ধরে অতিরিক্ত রাগ, আবোলতাবোল কথা বলা, অস্থিরতা সমস্যার কথা জানালেন। রোগের ইতিহাস নিয়ে জানা গেল তার ১ মাস ধরে ভালো ঘুম হচ্ছিল না। সিজারিয়ান সেকশন করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন দেড় মাস আগে। পনেরো মাস বয়সি আর একটি সন্তানও তার রয়েছে।
* কেইস হিস্ট্রি-২ : অনামিকা, ৩৩ বছর বয়স। মানসিক হাসপাতালের আউটডোর এ এসেছেন ঘুমের সমস্যা, আত্মহত্যার চিন্তা, সবকিছুতে নেতিবাচক চিন্তা, হতাশা, খাওয়ায় অরুচি, কিছুই ভালো না লাগা, অকারণে কান্না আসা, এমনকি নবজাতক সন্তানের জন্যও কিছু করার ইচ্ছা জাগে না, বিরক্তি বোধ হওয়া ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে।
সন্তান জন্মের ১০ দিন পর থেকে এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করেছে। গর্ভে সন্তান আসার ২ মাস পর থেকে তার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করত, যেমন সে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারবে তো? কারণ তার বোনের একটি অটিস্টিক শিশু আছে। ধীরে ধীরে এ উদ্বেগ বিষণ্নতায় রূপ নেয়।
তার প্রেগন্যান্সি যখন ৭ মাস, তখন থেকেই তার মধ্যে সব কাজে অনীহা, এমনকি গাইনি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে নিয়মিত ফলোআপ করানো, কারও সঙ্গে কথা বলা, ইত্যাদিতেও তাগিদ অনুভব না করা, সারাদিন শুয়ে থাকা ইত্যাদি সমস্যা শুরু হয়েছিল।
* কেইস হিস্ট্রি-৩ : চন্দ্রা, ৩৪ বছর বয়স, ২ মাস হয় কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। নরমাল ডেলিভারি হয়েছিল। মা ও সন্তান সুস্থই ছিলেন। তার স্বামী প্রবাসে থাকেন। শাশুড়ি চেয়েছিলেন এবার পুত্রসন্তান হোক। কারণ এর আগে দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। এসব নিয়ে শাশুড়ি অনেক কথা শোনায়, হুমকি দেয় ছেলেকে আবার বিয়ে করাবে। একই সঙ্গে সন্তানদের দায়িত্ব এবং গৃহস্থালির অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়।
দিনে-রাতে কখনোই শান্তিতে একটুও ঘুমাতে পারেন না। কিছুদিন ধরে তার কানে গায়েবি আওয়াজ আসতে থাকে, তোর এ সন্তান তোর জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে। ওকে মেরে ফেল। একবার সে বাচ্চাটাকে মাথার ওপর উঠিয়েছেও। প্রতিবেশী তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে আসে চিকিৎসার জন্য।
* কারণ
* নবজাতক শিশুর যত্নে নতুন দায়িত্ব পালন যেমন, একটু পরপর ঘুম থেকে জেগে খাওয়ানো, ডায়াপার বদলানো, কোলে নিয়ে হাঁটা ইত্যাদি।
* হরমোনের তারতম্য।
* প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা, বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার, সাইকোসিস, অনিদ্রা রোগ/ইনসমনিয়া, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার, ইত্যাদি।
* সঙ্গীর সাপোর্ট না থাকা
* একাধিক কাজের দায়িত্ব পালন ইত্যাদি।
** প্রসব-পরবর্তী অনিদ্রা রোগ/ইনসমনিয়ার লক্ষণ : ঘুম না আসা, একটু পরপর ঘুম ভেঙে যাওয়া, খুব সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে না পারা, ঘুম থেকে ওঠার পর ফ্রেশ না লাগা, ইত্যাদি সমস্যা যদি তিন মাস ধরে, সপ্তাহে তিন বা বেশি রাত ধরে থাকে, তাহলে এটাকে ইনসমনিয়া বলা যাবে।
** প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার লক্ষণ
* অস্থিরতা, মনোযোগে সমস্যা, অকারণে কান্না আসা, কিছুই ভালো না লাগা, সারাদিন শুয়ে/বসে থাকা।
* খাওয়ার রুচি কমা অথবা বাড়া।
* সবকিছু অর্থহীন মনে হওয়া, কিছু করার তাগিদ অনুভব না করা, তার নবজাতক শিশুটির জন্যও কোনো অনুভুতি না থাকা।
* উদ্বেগজনিত চিন্তা।
* ঘুমের সমস্যা হওয়া।
* মতিভ্রম, ভ্রান্তবিশ্বাস, অসংলগ্ন কাজ ও কথা বলা, একেবারেই কথা না বলা।
* আত্মহত্যার চিন্তা/চেষ্টা করা।
** পরিণতি : দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লামেশন, ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়া ইত্যাদি সমস্যা তৈরি হয়।
** প্রতিকার : কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, শারীরিক ব্যায়াম, মেডিটেশন, রিলাক্সেশন চর্চা, কাপল কাউন্সেলিং, পরিবারের সাপোর্ট। প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা ও সাইকোসিসের চিকিৎসা করা।
অনেকেই দ্বিধান্বিত থাকেন এই ভেবে যে, মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ালে সন্তানের ব্রেইনের যদি কোনো ক্ষতি হয়, যদি সন্তান ওষুধে নির্ভরশীল হয়ে যায়, ইত্যাদি। প্রসব-পরবর্তী মায়েদের চিকিৎসা না করলে মা, সন্তান এবং অন্যরা যেসব ঝুঁকিতে থাকেন, তা চিকিৎসা করলে নবজাতকের ওপর যেসব প্রভাব পড়তে পারে তার চেয়ে বেশি খারাপ।
তাই মায়েদের চিকিৎসায় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়। প্রেগনেন্সি এবং সন্তান জন্মের পর মায়েদের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত নির্ণয় করতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে, প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। একজন সুস্থ মা একজন সুস্থ সন্তান জন্মদান করতে পারেন, পারেন সন্তানকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে, সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে।
লেখক : সহকারি অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
