করোনাকালে অসহায় নাটোরের বিক্রয়কর্মীরা
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নাটোরে আমানা বিগ বাজার সুপার শপের দুটি দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন উর্মি খাতুন ও ইসরাত জাহান আইরিন। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের আর সংসারের খরচ চালাতে কাজ করছেন তারা। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের ও অভাব-অনটনের কথা তুলে ধরেছেন মো. মাহ্ফুজ আলম মুনী।
মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই : উর্মি খাতুন
নাটোর শহরের একটি সুপার শপে প্রসাধনীর দোকানের বিক্রয়কর্মী উর্মি খাতুন। থাকেন তেবাড়িয়া এলাকায়। বাবা-মা আর ছোট দু’বোনকে নিয়ে ছিল উর্মির সংসার। বাবা মো. মামুন ছিলেন একজন দিনমজুর। বাবার একার আয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্যের সংসার চালান কঠিন হয়ে পড়ত। উর্মি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় অসুস্থ হয়ে হঠাৎ তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুতে সংসারে দেখা দেয় আর্থিক সংকট।
বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সম্পত্তি বিক্রি করে চলতে থাকে তাদের চার সদস্যের পরিবারের খরচ। মা রেশমা বেগম সংসারের হাল ধরতে অল্প বেতনে একটি বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। এভাবে কয়েক বছর চলতে থাকে তাদের সংসার। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় বগুড়ার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় উর্মির। বেশিদিন টেকেনি সেই সংসার। মাদকাসক্ত স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন উর্মি। স্বামীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
এ প্রসঙ্গে উর্মি বলেন, আমার স্বামীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কোনো সহযোগিতা পাইনি। একপর্যায়ে মাদকাসক্ত স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বগুড়া থেকে নাটোরে মায়ের সংসারে ফিরে আসি। আবার লেখাপড়া শুরু করি। পাশাপাশি মাকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আমানা বিগ বাজার সুপার শপে মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে বিক্রয়কর্মীর চাকরি নিই। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পরই শুরু হয় করোনাভাইরাসের থাবা।
এর প্রভাব আমার পরিবারেও এসে লাগে। করোনার কারণে মায়ের চাকরি চলে যায়। সংসারে দেখা দেয় অভাব। তবুও হাল ছাড়িনি। মানুষের সমালোচনা এড়িয়ে বাস্তবতাকে মেনে চাকরি করছি। কারণ আমার দু’বোনের লেখাপড়ার খরচ ও আমার লেখাপড়ার খরচ; সবচেয়ে বড় কথা- বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাছে হার মানব না। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীদের বাজে কথা উড়িয়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে চাই। করোনার থাবায় লকডাউনে যখন মানুষ ঘরবন্দি, তখন স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই কাজে গিয়েছি। জীবনের ঝুঁকির কথা না ভেবে, পরিবারের কথা ভেবে সুপার শপে নিয়মিত কাজ করেছি। যদিও করোনার প্রথমদিকে সুপার শপ কয়েকদিন বন্ধ ছিল। এরপরে নিয়মিতই খোলা ছিল। সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত মেয়েদের প্রসাধনীসামগ্রী বিক্রি করি। করোনার সময় লোকজন বাড়ি থেকে তেমন বের না হওয়ার কারণে বেচাকেনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তাতে কর্মীদের বেতন নিয়ে সমস্যা হয়নি। লেখাপড়া শেষ করে একজন ব্যাংকার হতে চাই। সংসারের হাল ধরতে চাই।
কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি : ইসরাত জাহান আইরিন
ইসরাত জাহান আইরিন। নাটোর কানাইখালী মহল্লায় মা-বাবা আর দু’বোন নিয়ে তাদের সংসার। বাবা আয়ুব আলী একজন মোটর মেকানিক। করোনার সময় থেমে যায় তাদের আয়ের পথ। সংসারে নেমে আসে অভাব আর দারিদ্র্য। উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেও টাকার অভাবে আর এগোয়নি আইরিনের লেখাপড়া। আইরিন বলেন অনেক স্বপ্ন ছিল কলেজ পেরিয়ে সরকারি চাকরি করব। কিন্তু বাস্তবতার কাছে থমকে গেছে আমার স্বপ্ন।
বাবার একার রোজগারে আমার লেখাপড়ার খরচ চালান সম্ভব নয়। সংসারের হাল ধরতে আমানা বিগ বাজার সুপার শপে পোশাক বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ নিই। করোনার সময় বাবার একমাত্র উপার্জনের মেকানিক্যাল দোকানটি অনেকদিন বন্ধ থাকে। এতে চরম আর্থিক সংকটে পড়তে হয় আমাদের। আমার সামান্য বেতনের টাকা দিয়েই কোনোমতে দিন পার করেছি। করোনাকালে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রতিনিয়তই কর্মস্থলে এসেছি।
বাবা-মা আর ছোট বোনদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেয়াই ছিল- আমার মূল ভাবনা। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও মাস্ক পরে কাজ করছি। ক্রেতাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন বয়সী নারী। নির্ধারিত দামে পোশাক বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে দরদামের ঝামেলা পোহাতে হয় না। সুপার শপে কাজের পরিবেশ ভালো। নারী বিক্রয়কর্মীদের জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মাস শেষে ঠিক সময়মতো বেতন পাওয়ায় সংসারের অভাবটাও কিছুটা কমেছে।
