একাত্তরের রণাঙ্গনে স্বেচ্ছাসেবিকা
শিল্পী নাগ
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নারী নেত্রী, ছাত্রীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গড়ে ওঠে ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই। স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর প্রধান ছিলেন জাহানারা হক, সাধারণ সম্পাদিকা ফোরকান বেগম, সহ-সভানেত্রী আম্বিয়া আজম, সুচিত্রা গাঙ্গুলী, কোষাধ্যক্ষ রিজিয়া চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদিকা মিনারা বেগম (ঝুনু), সদস্য ফিরোজা আতিক, নাসিমুন নাহার হুদা ও সাজেদা চৌধুরী। তাদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন নারায়ণগঞ্জের ফরিদা আক্তার, নূরুন্নাহার জহুর, আলী আজম, শেফালী সাহা, গৌরী গাঙ্গুলী ও নিলুফার পান্না প্রমুখ। এই বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন এম.এন.এ বদরুন্নেছা আহম্মদ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা করা হয় : নার্সিং শাখা কমিটি, গেরিলা ট্রেনিং কমিটি, হাসপাতাল ট্রেনিং কমিটি, রিলিফ ট্রেনিং কমিটি, মাতৃ ও শিশু কল্যাণ ট্রেনিং কমিটি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য আগরতলা মহিলা নার্সিং শাখা কমিটি গঠন করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের নার্সিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় আগরতলার দুটি হাসপাতালে। একটি কুঞ্জবনে জিবি অর্থাৎ গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতাল এবং অন্যটি ভিক্টোরিয়া ভিএম হাসপাতাল। এ ছাড়া বিশ্রামগঞ্জ, মেলাঘর, গোকুলনগর হাসপাতালগুলোয় নার্সিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। শরণার্থী শিবির থেকে বাছাইকৃত মেয়েদের নার্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেয়েদের প্রশিক্ষণের কনভেনর ছিলেন বদরুন্নেছা আহমেদ।
১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ১৫ দিনের প্রথম ব্যাচে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন শিখা চক্রবর্তী, নূপুর, সীমা, প্রীতি কণা দাস, অঞ্জলি, রমা মজুমদার, স্মৃতি কণা, দিপালী রানী দাস, শায়লা আখতার, লক্ষ্মী চক্রবর্তী। দ্বিতীয় ব্যাচে ১৫ সেপ্টেম্বর নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন আমিনা সুলতানা, তাহমিনা আক্তার, মাফছুরা খাতুন, আমিরা খাতুন, রওশন শর্মিনা চৌধুরী, তাহরিমা, খোরশেদ আরা বেগম, সামশেদ আরা বেগম, কাজী হেলেন, গৌরী রানী পাল, পরিনীতি পাল চৌধুরী।
ডা. ফৌজিয়া মোসলেম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিকিৎসকের এবং চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করেছিলেন। চিত্রশিল্পী সাঈদা কামাল, সুলতানা কামাল সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলায় দুই নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ক্যাপ্টেন আখতারের ফিল্ড হাসপাতালে জুন মাসে নার্স হিসাবে যোগ দেন। এ হাসপাতাল তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন ডা. ডালিয়া সালাহউদ্দিন, পদ্মা, নীলিমা, আসমা, রেশমা, নৃত্যশিল্পী মিনু বিল্লাহ, জাকিয়া খাতুন প্রমুখ। ২৬ আগস্ট এ হাসপাতাল স্থানান্তরিত হয় বিশ্রামগঞ্জে।
ডা. মাখদুমা নারগিস রত্না
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ডা. মাখদুমা নারগিস রত্না ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্য যে পৃথক গেরিলা বাহিনী ছিল, তাদের শিবিরে গিয়ে হাজির হন? আগরতলা শরণার্থী শিবিরের পাশে ছোট্ট ঘরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা দিতেন। এ ছাড়া যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে উপযুক্ততার সনদ দিতেন? এ ছাড়াও নারী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সভা-সমাবেশ করতেন? মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে অসংখ্য রোমহর্ষক এবং হৃদয়বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন? এ প্রসঙ্গে ডা. মাখদুমা নারগিস রত্না বলেন, আগরতলায় শরণার্থী শিবিরের পাশেই একটি ছোট ঘরে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো? একদিন দুটি ছোট ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে ঘোরাঘুরি করছিল? তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর হবে? আমার সব কাজ শেষ হওয়ার পর তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তারা সেখানে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছে? তখন তারা বেশ কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক নানা কথা বলে একটা তালপাতার ঠোঙা বের করে আমাকে দিতে চায়? আমি বললাম, এটা আমি কেন নেব? কী আছে এতে? তারা বলল, তারা মাত্র বাংলাদেশ থেকে এসেছে? দেশ থেকে সঙ্গে করে গুড় নিয়ে এসেছে? আমি বললাম, এটা তোমাদের কাছেই রাখ? তোমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়ার অনেক কষ্ট হবে? তারপরও তারা বলল, না আপনার ছোট বাচ্চা আছে তাকে এটা দেবেন? এর পরও তারা চলে না গিয়ে বসেই আছে? তখন জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কি আরও কিছু বলার আছে? তখন তারা জানাল মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ? আমি বললাম, ১৮ বছরের কম বয়সের কাউকে তো আমরা যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি না?
ডা. নূরুন্নাহার জহুর
ডা. নূরুন্নাহার জহুর আগরতলা জেভি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেন, শরণার্থী ক্যাম্পে প্রসূতি ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা দেন ও রিলিফ প্রদানে অংশ নেন।
ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন হায়দারের ছোট বোন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চিকিৎসক ও সেনা সদস্য ডা. সিতারা বেগম দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগানোর পথ খুঁজছিলেন? এর মধ্যেই ভাই ক্যাপ্টেন হায়দারের চিঠি পান সিতারা এবং তার পরিবারের সদস্যরা? ভাইয়ের চিঠি পেয়েই তিনি আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বলেন, জুলাই মাসের শেষ দিকে ভাইয়া দুটি ছেলের হাতে পেনসিল দিয়ে লেখা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন? চিঠিতে তিনি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন? বিশেষ করে আমাকে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন সেটিও উল্লেখ করেন? এ ছাড়া তাদের হাতে আমার জন্য একটা ছোট পিস্তল পাঠিয়েছিলেন? এ নির্দেশ দিয়ে যে, যদি পথে কোথাও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ি, তাহলে যেন আমি সেই পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করি? তো আমি ভাইয়ার পাঠানো সেই ছোট্ট পিস্তলটি ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতাম? পরের দিন আমরা রওনা করলাম? গ্রামের মেয়েদের মতো শাড়ি পরে খালি পায়ে আমি অন্যদের সঙ্গে রিকশায় উঠলাম? গুজাদিয়ার ঘাটে এসে নৌকায় উঠলাম? নৌকায় সাত দিন সাত রাত কাটিয়ে আমরা সিলেট সীমান্ত দিয়ে টেকেরঘাট পৌঁছি? সেখানে পৌঁছার পর দেখি ভাইয়া এসে হাজির। অথচ আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তারপরও কীভাবে ভাইয়া আমাদের খবর জানলেন সেটি এখনো একটি রহস্য বলে মনে হয়। এর মধ্যে ভাইয়া এক ভারতীয় মেজরকে বলে রেখেছিলেন, আমার পরিবারকে নিয়ে যাব, একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। সেই অনুসারে মেজর একটি পিকআপ ভ্যান রেখেছিল আমাদের জন্য? কিন্তু পেছনে দেখি সিমেন্টের বস্তা ভর্তি? এটা দেখে প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে বুঝলাম, খুব উঁচু-উঁচু বোল্ডারের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িটি যেন খুব বেশি লাফাতে না থাকে, সে জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই সিমেন্টের বস্তা রাখা হয়েছিল? সেই পিকআপে করে পৌঁছলাম। দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হাসপাতাল। দুই নম্বর সেক্টরে আশ্রয় নেওয়া মেডিকেলে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে অল্প কিছু শয্যার ব্যবস্থা করে শুরুতে এ হাসপাতাল গড়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে তা হয়ে ওঠে প্রায় ৪০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। এ হাসপাতাল হয়ে ওঠে রণক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক আশ্রয়ের ঠিকানা। জুলাইয়ের শেষদিকে আমি সিও হিসাবে এ হাসপাতালের দায়িত্ব নিই। সবার আন্তরিক পরিশ্রম, আত্মনিবেদন ও পরিকল্পনায় এ হাসপাতালকে এক অনন্য হাসপাতালের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা গুলিবিদ্ধ, স্পিন্টারের আঘাতে ঝাঁজরা, গুরুতর জখম মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে হতো খুব সামান্য আর সাধারণ ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে।
মিনু বিল্লাহ
বিশ্রামগঞ্জে হাসপাতাল তৈরির জন্য জমি দিয়েছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। এ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করার জন্য আসেন নৃত্যশিল্পী মিনু বিল্লাহ। মিনু বিল্লাহ বলেন, বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল আর আর্মি ক্যাম্প বিশাল এলাকাজুড়ে। বিশ্রামগঞ্জে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট অনুভব করে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। ওখানে গাছভর্তি ছিল পেয়ারা। পেয়ারা খেয়েই পেট থাকত ভরা। পেছনে একটি পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতাম বাকি মেয়েদের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে লাল কাঁকর বিছানো পথে হেঁটে যেতাম সুলতানা কামালদের সঙ্গে। এর মধ্যেই শুনতাম দুঃসহ সব খবর। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কবে শেষ হবে কিছুই জানতাম না। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আসার যাত্রাটাও সহজ ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বিশ্রামগঞ্জ থেকে কলকাতা চলে যাই সুলতানা কামালদের সঙ্গে। উঠি কেকা করিম আর জাওয়াদুল করিমের আস্তানায়। জাওয়াদুল করিমের চাচার বাড়ির ঠিকানা ছিল ৫/২, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা-১৬। সেখানেই উঠেছিলাম আমরা।
লক্ষ্মী চক্রবর্তী
কুঞ্জবনে গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালে ডা. নিলয়, ডা. সেন ও ডা. ভৌমিকের কাছে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন লক্ষ্মী চক্রবর্তী। নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষে তিনি জিবি হাসপাতালে কাজ করার দায়িত্ব পান। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রানী দি আমাদের সঙ্গে রইলেন। আমি চিকিৎসারত আহত, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিই। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন খালেদ মোশারফ আহত হয়েছেন। তাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে এনে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেরাদুন হাসপাতালে পাঠানো হয়।
