বাল্যবিয়ে : সোনালি শৈশব হারিয়ে গেল বৃষ্টির
রীতা ভৌমিক
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বারান্দায় অনেক কষ্টে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন সিরাজগঞ্জ তাড়াশ উপজেলার দেশী ইউনিয়নের বলদি পাড়া দাখিল মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মোছা. বৃষ্টি খাতুন। বাল্যবিয়ের শিকার এ মেয়েটি বিয়ের আগে সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যেত। খেলাধুলা করত। লেখাপড়া শিখে ও একজন আলোকিত মানুষ হতে চেয়েছিল। কিন্তু বিয়ে নামক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে জীবন থেকে সোনালি শৈশব হারিয়ে গেল তার। বিয়েতে তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি একমাত্র অভিভাবক মা বাচা খাতুন। একই গ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে মমিনুলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে। ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিলে বৃষ্টির দরিদ্র বিধবা মা মেয়েকে চাপ দেন। স্থানীয় মৌলভী রায়হান মুন্সী এক লাখ ষাট হাজার টাকার যৌতুকে গোপনে বরের বোনের বাড়িতে মমিনুলের সঙ্গে বৃষ্টির বিয়ে পড়ান।
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার দেশী ইউনিয়নের মাসদক্ষিণের মৌলভী আবু রায়হান মুন্সী বলেন, আমাকে ডাকা হয় বিয়ে পড়ানোর জন্য। মেয়ের বয়স আঠারো পূর্ণ হয়েছে কিনা এ সম্পর্কিত কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে থাকে না। আমাদের দায়িত্ব বর-কনে রাজি থাকলে কলমা পড়ানো। বর-কনে কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে লিগ্যালভাবে হচ্ছে কিনা, কাবিননামা হয়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব থানা বা ইউনিয়নের কাজী সাহেবের।
কনের আঠারো বছর পূর্ণ না হওয়ায় কাবিননামা করা হয় না। মমিনুল শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বৃষ্টি স্বামী সাহচর্য মানতে পারেন না। এদিকে দরিদ্র মা বাচা বেগম তাড়াশের আদর্শ গ্রামের খাস জমিতে দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। মা ভেবেছিলেন, নিজের জমিজমা নেই, অন্যের বাড়িতে কাজ করে দিন পার করবেন। বৃষ্টির শ্বশুর মাছ ব্যবসায়ী। ভাসুর আর বর নিজের জমিতে কাজ করে। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেলে সুখে থাকবে। এরইমধ্যে বৃষ্টি একবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পাঁচদিন থেকে একাই মায়ের বাড়িতে চলে আসে। স্বামীর সঙ্গে থাকতে রাজি হয় না। বৃষ্টির মা মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর জন্য জামাই মমিনকে দাওয়াত দেন। ২০১৯ সালের ১৫ জুন মমিনুল শ্বশুরবাড়িতে এলে বৃষ্টির সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বৃষ্টি। সিরাজগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করায়। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে সেখান থেকে ১৬ জুন বৃষ্টিকে বগুড়ার শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। দুই হাসপাতালেই মোছা. বৃষ্টি খাতুনের স্বামীর নাম আ. মমিন উল্লেখ করা হয়েছে। ২৩ জুন হাসপাতাল থেকে বৃষ্টি বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু সুস্থভাবে নয়। বিষের তীব্র প্রভাবে বৃষ্টির শরীরের বিভিন্ন স্নায়ু এবং দু-পা অকেজো হয়ে পড়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে বৃষ্টির মা বাচা খাতুন বলেন, আমার বেটি চলাফেরা করতে পারে না। মমিনের বাপ এরইমধ্যে চাপ দেয় মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর। অসুস্থ মেয়েকে কেমনে শ্বশুরবাড়ি পাঠাই। তাই কিছুদিনের সময় চাইছিলাম। মেয়ে সুস্থ হইলে শ্বশুরবাড়ি পাঠাব। এই উছিলায় তারা ছেলেরে ২০২০ সালে ২২ অক্টোবর দেওঘরের আ. গফুরের মেয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিষ্টি খাতুনরে বিয়া কইর্যা ঘর সংসার করতাছে। এদিকে কাবিননামা না থাকায় তালাকও হয় নাই। তারা বিবিনের যৌতুকের টাকা চায়। বিবিনের টাকা দিতে পারি নাই বলে মেয়েরে নির্যাতন করছে। বিবিনের এক লাখ ষাট হাজার টাকা দিলে তারা কাবিন করব। কাবিননামা না থাকায় মামলা করতে পারি নাই। এদিকে মেয়ের চিকিৎসার খরচ চালাইতে কষ্ট হইতাছে। ও যে সুস্থ হবে সেই গ্যারান্টিও ডাক্তার দেয় নাই।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের বাংলাদেশ ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর ফিরোজা খাতুন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান বরাবর সুপারিশ করেন। চেয়ারম্যান ওই এলাকার মাতবর মো. আলহাজ শামছুল হককে দায়িত্ব দেন। তিনি ছেলে-মেয়ে উভয়পক্ষকে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন, বৃষ্টিকে সুচিকিৎসার জন্য কয়েক মাস সময় দেয়া প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত ছেলের বাবা আব্দুল মতিন মেনে নেয় না।
বৃষ্টির শাশুড়ি আকলিমা ছেলে মমিনুলের প্রথম বিয়ের কথা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে স্বীকার করেন। মমিনুলের মা আকলিমার মতে, আমার ছাওয়ালের সঙ্গে বৃষ্টির বিয়া হয় নাই। আগের বৌ জামাইর কথা শুনে না। জামাইর কথা শুনতেই পারে না। আমার ছাওয়ালের ঘর করব না। কার্তিক মাসে ছাওয়ালরে দেওঘরে আবার বিয়া করাইছি।
