নারীবান্ধব নিরাপদ নগর গড়তে
সাহসী কন্যা (যুব নেটওয়ার্ক) নারীবান্ধব নিরাপদ নগরায়ণে সবার অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিতকরণে কাজ করছে। ঢাকার তিন প্রতিবন্ধী কর্মজীবী নারীর জীবনের গল্প নিয়ে লিখেছেন-
রেনেকা আহমেদ অন্তু
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকায় বসবাসরত সানজিদা আক্তার জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী। শারীরিক প্রতিবন্ধিকতাকে জয় করে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। শিক্ষাজীবনে মেধাবী ছাত্রী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। অনেক সময়ে অবহেলার পাত্রও হয়েছেন। সানজিদা একটি বেসরকারি সংস্থায় কমিউনিকেশন অফিসার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। নিয়মিত গণপরিবহনেই যাতায়াত করেন। গণপরিবহনে যাতায়াতে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।
এ প্রসঙ্গে সানজিদা আক্তার বলেন, কেজিতে পড়ার সময় একবার পরীক্ষায় প্রথম হয়েও প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসাবে আমার হাঁটাচলা অন্য সাধারণ মানুষের থেকে তুলনামূলক একটু কম। আমার উচ্চতাও তুলনামূলক অনেক কম। একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বাড্ডায় রাস্তা পারাপারের সময় আমি প্রায় এক গাড়ির নিচে এসে পড়েছিলাম। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলাম। পথচারীরা যখন গাড়িচালককে বকাবকি করছিলেন, গাড়িচালক বলেছিলেন, ‘তিনি দূর থেকে আমাকে লক্ষ্যই করেননি।’ আমি নিজেও ব্যাপারটির সঙ্গে একমত। উঁচু গাড়ি থেকে চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার কাউকে চোখে না পড়াটা অবাস্তব নয়। রাজধানীতে অনেক ফ্লাইওভার রয়েছে। আমাদের মতো মানুষের কথা চিন্তা করে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকাতে ফুটওভার ব্রিজ হয়, তবে অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিতের জন্য জেব্রাক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ফুটপাতগুলো সরু, একদমই হুইলচেয়ার ব্যবহার উপযোগী নয়। তার ওপর ইদানীং গ্যারেজ থেকে গাড়ি চলাচলের জন্য বাড়ির সামনে ঢালু করে নেওয়ার চল বেড়েছে! সেই পথ কীভাবে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চলতে পারে।
২০১৯ সালের তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৭ ভাগেরও অধিক প্রতিবন্ধী। নগর পরিকল্পনায় নেই সবার সমান অধিকার, নেই মানবিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, সুস্পষ্ট কার্যকরী পলিসি। ঢাকায় বসবাসরত ২৭ বছরের সুমনা খান জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোটবেলা থেকেই তাকে নানা বাধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। স্কুলজীবনে শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাকে অন্যদের থেকে বাড়তি চেষ্টা করতে হয়েছে। যাতে কখনোই সমাজ তাকে পেছনে টেনে না ধরে। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ইডেন কলেজ থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর করেছেন। ইতোমধ্যে প্রোগ্রাম অফিসার হিসাবে কাজ করেছেন কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনে। কাজ করছেন পার্টটাইম ভয়েসওভারে। পেশাগত ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সুমনা খান যাতায়াত করেন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে।
এ প্রসঙ্গে সুমনা খান বলেন, আমাদের দেশের গণপরিবহনগুলোর ডিজাইনই করা হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা না ভেবে। ধরেই নেওয়া হয়েছে, প্রতিবন্ধী মানুষদের রোজ যানবাহন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না।
অথচ কোনো চাকুরিতে তো আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কেবল যাতায়াতের জন্যই বাড়তি পয়সা দেওয়া হয় না! অতএব, যে দেশে বর্তমানে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার, সেই দেশে চাকরি পেলেও রোজ অফিস এর যাতায়াত খরচ মিটিয়ে কত টাকা ঘরে আনা যাবে- এটা প্রতিবন্ধী কর্মজীবী মানুষদের চাকরিতে যোগদানের পূর্বেই ভাবতে হয়, কখনো কখনো চাকুরি পেয়েও ছাড়তে হয়। প্রতিবন্ধী নারীদের বিনোদন নিয়ে নগরের ভাবনা নেই বললেই চলে! আমাদের দেশের পার্ক ও মাঠ কতটা প্রতিবন্ধী বান্ধব তা নিয়ে তেমন জোরালো প্রতিবাদ গড়ে উঠে না।
নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুমনা খান জানান, যে শহরের পরিকল্পনায় সব শ্রেণির মানুষের জন্য সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে, থাকে না পথে-ঘাটে শারীরিক/মৌখিক যৌনসন্ত্রাস, যে শহরের গণপরিবহনগুলো সবার প্রবেশাধিকারের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে, সে শহরই তার কাছে নিরাপদ শহর।
২০০৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মেহেরপুরের আকলিমা খাতুন আজীবনের জন্য দু’পায়ে ভর করে চলাচলের সামর্থ্য হারান। এজন্য পরিবারের অনেকের কাছেই হয়েছেন হেলার পাত্র। অনেকে তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তবুও হার মানেননি। কখনো কখনো শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছেন, কখনো কখনো হয়েছেন প্রশাসনের গাফলতির শিকার। কখনো নিচতলায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, কখনো চারতলায় গিয়েও পরীক্ষা দিয়েছেন। সব বাধা পেরিয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে রায়পুর প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। নগরের যাতায়াতে আকলিমা খাতুন অহরহ শিকার হয়েছেন নানা হয়রানির। শুনেছেন ‘শারীরিক প্রতিবন্ধকতা’ নিয়ে নানা কটুক্তি।
আকলিমা খাতুন বলেন, আমাদের দেশ ডিজিটাল হচ্ছে। এখনো প্রায় সড়কেরই সিসিটিভি ক্যামেরা অকেজো দেখা যায়। এর ফলে ছিনতাইয়ের হার দিনদিন বাড়ছে। এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোগান্তি বাড়ছে। পার্ক, রাস্তা যে কোনো জায়গায় প্রতিবন্ধীরা ছিনতাই, চুরির শিকার হচ্ছেন। সুবিচারও পান না তারা। সুনির্দিষ্ট, ব্যাখ্যামূলক আইনের সুশাসন নগরের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত নারীদের বিরুদ্ধে ঘটা যৌনসন্ত্রাস রোধে আইনের সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিকরণ নারীবান্ধব নগর গড়তে সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধিরও আবশ্যকতা রয়েছে।
