Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

মাদক থেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার এক নাম লায়লা হায়দারি

Icon

আবুল বাশার ফিরোজ

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদক থেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার এক নাম লায়লা হায়দারি

লায়লা হায়দারি। আফগানিস্তানের একজন মানবাধিকার কর্মী। দেশের মাদকাসক্ত মানুষকে নেশার জগৎ থেকে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসন করছেন। তার ভাই হাকিম হঠাৎ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। ভাইয়ের বউ তাকে প্রথম খবরটি দেন। এ রকম আকস্মিক খবরে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। পুরো পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েন। ভাইকে মাদকাসক্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে তিনি ২০১০ সালে রাজধানীর কাবুলে মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। আফগানিস্তানে এটিই প্রথম বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র।

এ প্রসঙ্গে লায়লা হায়দারি বলেন, হাকিমের মাদকাসক্তির কথা প্রথমে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করেন। এটা লজ্জার বিষয়। জানাজানি হলে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হতো। কিন্তু অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। হাকিমের স্ত্রী আরেকদিন ফোন করে আমাকে বলে আমার ভাই নাকি এখন বাড়িতেই মাদক গ্রহণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভাইয়ের বাড়িতে ছুটে গেলাম। ওদের তিনটি ফুটফুটে কন্যা। আমি দেখলাম, আমার ভাইসহ অন্যান্য চাচাতো, ফুপাতো ভাইয়েরা সবাই বাচ্চাদের সামনেই ড্রাগ নিচ্ছে। বাচ্চাদের ফুপু হিসাবে আমার মনে হলো, আমার কিছু একটা করা দরকার। এ বাচ্চাদের সুস্থ জীবনযাপনে আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। কারণ আমি চাই বাচ্চারা সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠুক। তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হোক। এসব থেকে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। কিন্তু ও তখন কাবুলের কুখ্যাত একটি ব্রিজের নিচে গিয়ে থাকতে লাগল যেখানে মাদকাসক্ত বহু মানুষ বসবাস করত। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় ওর স্ত্রী মোটেও খুশি ছিল না। কারণ আমার ভাইয়ের বউ বাড়িতে একা হয়ে পড়ে। আমাকে ফোন করে ও কাঁদে। আমাকে বলল, ‘হাকিমকে খুঁজে বের করতে’। ওই ব্রিজের নিচে আমি যখন পৌঁছলাম, দেখলাম সেখানে চার হাজারের মতো মাদকাসক্ত ব্যক্তি। সবাইকে অর্ধমৃত বলে মনে হচ্ছিল-রোগা পাতলা, পরনে নোংরা কাপড়। আমি ভাবলাম এদেরও তো স্ত্রী ও বাচ্চাকাচ্চা আছে। তারাও নিশ্চয়ই তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। জীবনে এ রকম মর্মান্তিক দৃশ্য এর আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছিল লোকগুলো যেন নরকে বসবাস করছে। যেভাবে তারা আফিম ও হেরোইন গ্রহণ করছে, দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন নরকের আগুনে নিজেদের পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত সবকিছু হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে ভাইকে খুঁজে বের করলাম। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমি আমার পরিবারের প্রথম সন্তান। সবাই আমাকে বাবার মতোই দেখত। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম ভাইসহ আরও যারা আসক্ত তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু একটা করব।

হেরোইন খুবই কড়া নেশা। আফিম গাছ থেকে এটি উৎপন্ন হয়। এর চাষ হয় মধ্য এশিয়ায়। ফলে এ অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে আফিমের চাষ হচ্ছে। আফগানিস্তানেও মাদকাসক্তি দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। কিন্তু ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তানে অভিযান চালানোর পর সেখানে হেরোইনের চাষ ও মাদকাসক্তি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। লায়লা হায়দারি ভাবলেন, এটা তো শুধু কারও একার সমস্যা নয়। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলো এ মাদকের ব্যবসা করছে। আফিমচাষিরা কিন্তু এখনো দরিদ্র। শীতকালে পরার মতো গরম জুতা কাপড়ও তাদের নেই। ভাইকে মাদকাসক্তি থেকে বের করে আনার জন্য একটি বই ভাইকে পড়তে দেন। ভাই হাকিম মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পান। কিন্তু লায়লা আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে সাহায্য করার কথা ভাবলেন। ২০১০ সালে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। কাবুলের একমাত্র বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে লায়লা হায়দারি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। কিন্তু এটা করতে তার যেমন প্রচুর সাহসের প্রয়োজন ছিল, তেমনি দরকার ছিল লেগে থাকার মতো শক্ত মনোভাব।

মাত্র বারো বছর বয়সে লায়লার বিয়ে হয়। স্বামী ছিল তার চেয়েও বয়সে অনেক বড়। তিনি ছিলেন খুবই ধার্মিক এক মোল্লাহ। তাদের এ সংসার টিকেনি। এরপর তিনি শুরু করেন নিজের ব্যবসা। এর মধ্যেই পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। এ সময় জঙ্গিরা তাকে হত্যার হুমকি দেয়। ফলে তার এ যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিয়ের সময় আমি শিশু ছিলাম। একজন পুরুষের সঙ্গে থাকার জন্য তখনো শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার স্বামী যখনই আমার সঙ্গে ঘুমাতেন, সেটা ছিল যৌন নির্যাতনের মতো। কারণ আমি তো একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মতো কিছু অনুভব করতে পারিনি। এ ছাড়া তিনি ছিলেন খুবই কট্টর। সবকিছুতেই তার ভিন্ন ধরনের মতামত ছিল। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি সেটা ছিল খুব উদার ও খোলা মনের। তিনি আমাকে সৌদি নারীদের মতো কালো বোরকা পরতে বাধ্য করতেন। চোখ ছাড়া পুরোই শরীর আবৃত থাকত। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে কষ্ট হতো। আমার পরিবার কখনো আমাকে এটা পরতে বলেননি।

তার সঙ্গে ঘুমাতে আমি ঘৃণা করতাম। তাই আমি তাকে তালাক দিয়ে দেই। সন্তানদের জন্য এটা ছিল খুব বড় একটা আঘাত। কিন্তু আমি আশা করি তারা বুঝতে পেরেছে যে আমাকে কী কারণে সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে।

লায়লা হায়দারির তিন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। কিশোরী থাকতেই এসব সন্তানের জন্ম হয়। আফগান আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদের পর তাদের পিতার সঙ্গেই থাকতে হয়েছে। সন্তানদের তিনি বড় করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু যে ক্যাম্প তিনি গড়ে তুলেছেন, তার নাম দিয়েছেন মায়ের ক্যাম্প। সেখানে অনেকেই তাকে মা বলে সম্বোধন করেন। এ অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, তারা যখন মা বলে ডাকে তখন আমার খুব ভালো লাগে। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। আমার মনে হয়, যে পরিশ্রম করেছি, আত্মত্যাগ করেছি, সেটা যেন সার্থক হয়েছে। জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় আমি পার করেছি মানুষকে সাহায্য করতে যাতে তারা নরক থেকে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমার সন্তানরা গর্ব করে যে তাদের ছাড়াও আমি আরও এত সন্তানের মা হয়ে উঠেছি। আফগানিস্তান এখন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। আমেরিকান সৈন্যরা ফিরে গেছে নিজেদের দেশে। আমি এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না। এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিরাময় ও পুনর্বাসনে সাহায্য করেছে আমার প্রতিষ্ঠিত মায়ের ক্যাম্প।

 

নেশা মাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম