Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

নবাবগঞ্জে মাধুরী বণিকের সঙ্গে

Icon

মাসুদ করিম নবাবগঞ্জ থেকে

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাজী মুকুল হঠাৎ আমাকে ফোন করে মাধুরী বণিকের টেলিফোন নম্বর চাইলেন। মাধুরীকে নিয়ে যুগান্তরের নারী বিষয়ক ‘সুরঞ্জনা’ পাতায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সুরঞ্জনা পাতার নিয়মিত লেখক শওকত আলী রতন প্রতিবেদনটি লেখেন।

মাধুরী বণিকের বয়স ৬৯ বছর। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন। পড়ার পর সেসব বই ফিরিয়ে নিয়ে অন্য বাড়িতে পড়তে দেন। ২৫ বছর ধরে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই নিরলসভাবে তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। গরিব শিশুদের লেখাপড়ার জন্য তিনি গাছতলায় চালু করেছেন একটি পাঠশালা।

সুরঞ্জনায় মাধুরী বণিককে নিয়ে আধা পৃষ্ঠা জুড়ে লেখাটি ছাপা হয়। লেখার সঙ্গে বই নিয়ে হেঁটে যাওয়ার ছবি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, ‘সুরঞ্জনায় লেখা পড়ে আমরা মাধুরী বণিকের কথা জানতে পারি। আমরা তাকে কিছু বই দেব। এ জন্য টেলিফোন নম্বর প্রয়োজন’।

আমি মাধুরী বণিক ও শওকত আলী রতনের মোবাইল ফোন নম্বর মুকুলকে দিলাম। কয়েকদিন পর আবার তিনি ফোন করলেন।

‘আমরা মাধুরী বণিকের কাছে যাচ্ছি।’ বললেন কাজী মুকুল।

‘আমাদের সাংবাদিককে সংবাদটি কাভার করার জন্য বলে দেব।’ আমার জবাব। তিনি বললেন, ‘আপনি নিজেই চলুন আমাদের সঙ্গে। ১৭ মার্চ ২০২৩, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। সেদিন যাব।’ আমি ক্যালেন্ডারে দেখলাম, দিনটি শুক্রবার। যুগান্তরে আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মদিনে সকাল আটটার মধ্যে রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যালয়ে পৌঁছলাম। গেটেই দেখা হয়ে গেল মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি সাদর সম্ভাষণ জানালেন। নির্মূল কমিটির অফিসে চা খেতে খেতে মুকুল জানান, মহাখালীর অর্পণ নিবাস নামের বাড়িতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের বাসা। ভবনটির একটি ফ্লোর তিনি সংগঠনটির অফিস চালানোর জন্য দিয়ে রেখেছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্মূল কমিটির অফিসে একে একে এলেন শাহরিয়ার কবির, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শহিদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সমাজকর্মী ও লেখক মমতাজ লতিফ, চারুশিল্পী আবুল বারক আলভী, শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর, সাংবাদিক মুন্নী সাহা, সমকালের আবু সালেহ রনি, জনকণ্ঠের মুরসালিন, ভোরের কাগজের আইন উদ্দিন প্রমুখ।

আমাদের গাড়ির বহর নবাবগঞ্জ রওনা হবার সময় ঘড়ির কাঁটায় সময় সকাল সাড়ে আটটা। মাধুরী

বণিকের জন্য সাড়ে ছয়শ বই প্যাকেট করে আগের দিন নবাবগঞ্জ পাঠিয়ে রাখা হয়েছে। মাধুরী বণিক যে গাছতলায় শিশুদের পড়ান, সেখানে সামিয়ানা খাটানো মঞ্চ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তাই শিশুরা এসেছে। তাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ হবে। শিশুর মায়েরাও এসেছেন। বিশাল আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ১০৩তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে মাধুরীকে এক লাখ তিন হাজার টাকা নগদ অনুদান দেওয়া হলো। তিনি এ টাকায় তার পাঠশালা, পাঠাগারের কাজ করবেন। সাড়ে ছয়শ বই দেওয়া হলো নির্মূল কমিটির তরফে। সাংবাদিক মুন্নী সাহা নিজে থেকে দিলেন আরও কিছু বই। আবেগে উচ্ছ্বাসে এক প্রাণময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। মাধুরী বণিকের কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তিনি জানান, ১৯৬৭ সালের ঘটনা। বণিক পাড়ার লোকেরা টাকা কামাই করলেও বই পড়ায় উৎসাহ নেই। মাধুরী তার মাকে বিষয়টা বললে মা এদের পড়ানোর জন্য উৎসাহ দেন। তখন পুকুরপাড়ে বসে মাধুরী সবাইকে পড়ান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মাধুরী তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন স্থানে খাবার নিয়ে গেছেন। অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন বিছানা ও বালিশের নিচে।

মাধুরী বলে চলেন, ‘স্বাধীন দেশে আবার বই পড়ার আন্দোলন শুরু করি। লোকে পড়তে চায় না। তাই বাড়ি বাড়ি বই নিয়ে যাই। এক সময় ৩০০ বই ছিল। অনেকে ফেরত না দেওয়ায় বই কমে গেছে।’ শিশুদের পড়ানোর পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও দেন তিনি। শাহরিয়ার কবিরের কথায় ক্ষোভ ও দ্বিধা। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো রাজাকার দেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পদক পেলেও মাধুরী বণিক পাননি। তবে তিনি এও বলেন, সরকারকে দোষ দিয়ে কী লাভ, যুগান্তরে শওকত আলী রতন প্রতিবেদন না লিখলে আমরা কীভাবে মাধুরীর কথা জানতাম!’

মাধুরী বণিক মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেও স্বীকৃতি চান। তিনি লাল-সবুজের পতাকা জড়িয়ে মরতে চান। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রতিশ্রুতি দিলেন, তারা এ ব্যাপারে চেষ্টা করবেন। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাধুরী বণিক সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন।’ মাধুরী বণিক সোনার মানুষ গড়ার এক বিশাল কারিগর।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম