সফল উদ্যোক্তা
স্বপ্ন দেখার সাহসই শক্তি শারমিনের
কাজী সুলতানুল আরেফিন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শখের বসেই পড়াশোনার পাশাপাশি সেলাই বা হাতের কাজ করতেন শারমিন। যা আয় হতো তাতে খুব সুখ অনুভব করতেন। এভাবেই চলছিল। মায়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে অনেক দূর পড়াশোনা করে দেশের ভালো কোনো নীতিনির্ধারক হবেন। কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়নি। বিয়ের পর ২০০৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই মা হলেন শারমিন। উদ্যোগটা থেমে গিয়েছিল তখন। কিন্তু পড়াশোনা থামেনি। অনার্স ভর্তি হয়েও ছোট বাচ্চা নিয়ে সবদিক সামলাতে না পেরে শেষে ডিগ্রিতে ভর্তি হলেন। পাশাপাশি ২০০৯ সালে বরিশাল এপেক্স হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিএইচএমএস (ডিপ্লোমা) ভর্তি হলেন। ডিগ্রি ও হোমিওপ্যাথি পড়াশোনা একসঙ্গে চলল। পড়াশোনা, সন্তান, সংসার নিয়েই কাটছিল সময়।
কিন্তু মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন সব সময় উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। কিছু একটা করতে হবে। শারমিন বলেন, ‘২০১১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি হলো। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিও চলল। পড়াশোনা শেষ হলো এক সময়। হোমিওপ্যাথি ডিপ্লোমাও শেষ হলো। চাকরির বেতনও যথেষ্ট নয়। ভাবলাম এবার চেম্বার নিয়ে বসার পালা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পেরে উঠছিলাম না। কেটে গেল আরও কয়েক বছর। ২০১৭ সালে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর ল্যাপটপটা অকেজো হয়ে যায়। তাই আর সুবিধা করতে পারলাম না। এরপর দেশে এলো মহামারি। অফিস টাইমের পর বাসায় এসে ঘরবন্দি হয়ে থাকায় মন খুব খারাপ থাকত। একদিন আমার এক কাজিন বললেন, তুমি তো অনেক কাজ জানো, রান্না জানো, বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড নিয়ে কাজ করতে পার। একটা পেজ খুলে রান্নার অনলাইন বিজনেস করতে পার। ভাবলাম, মন্দ বলেনি কথাটা। কিন্তু কাস্টমার যখন খাবার অর্ডার করবেন তখন আমি থাকব চাকরিতে। তাহলে তো বিজনেস চলবে না! হঠাৎ মনে হলো আমি যেহেতু আঁকিবুঁকি পারি, পেইন্টিং নিয়ে কাজ করতে পারি। পেইন্টিংয়ের বিভিন্ন পেজ দেখলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ফেব্রিকে পেইন্টিং করব। একটা পেজ ও গ্রুপ খুলি। সেই থেকে পথচলা শুরু। অনলাইন বিজনেসের জন্য একটা ভালো ক্যামেরা খুব প্রয়োজন ছিল, যা আমার ছিল না। ছিল শুধু একটা স্মার্টফোন। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে শুরু করি স্বপ্নের পথচলা। ২০২০ সালের ২৫ মে শুরু আমার স্বপ্নের পথচলা। শুধু একটা অনলাইন পেজ থেকে কাজ শুরু করি আমি। নিজেই অর্ডার নিতাম এবং ডেলিভারি দিতাম। সংগ্রামের গল্পগুলো লুকিয়ে রাখতাম নিজের ভেতর। আমাদের সমাজে নারীদের তো পদে পদে বাধা তৈরির চেষ্টা করেন কিছু মানুষ। আমি বরিশাল বিভাগীয় উদ্যোক্তা হাব, বরিশাল গ্রুপে যুক্ত হয়েছি ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে। কিন্তু এখানে অ্যাক্টিভ ছিলাম না। সাইলেন্ট মেম্বার ছিলাম। প্রথম থেকেই আমার উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নিটা সহজ ছিল না। পরিবার থেকে শুধু মায়ের সাপোর্ট পেয়েছি। সব সময় সাহস দিয়ে বলতেন, তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সৎ পথে চল, তাহলেই পারবে। পথটা অনেক কঠিন ছিল। বারবার হোঁচট খেয়েছি, বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি। এ পথচলায় একমাত্র সঙ্গী ছিলেন আমার মা। আজ মা নেই। মায়ের অবর্তমানে আর একজন মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি আমার খালামণি। সব সময় সাহস জুগিয়েছেন। ব্যবসা শুরু করেছিলাম মাত্র ১,৭০০ টাকা দিয়ে। সে টাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছিলাম। শাড়িতে পেইন্টিং করলাম। ২ মাসেও সেল হয়নি। এর মধ্যেই মা মারা গেলেন। শোকে ব্যবসা বন্ধ প্রায়। মাস পাঁচেক পর হঠাৎ ১টি শাড়ির অর্ডার এলো। ১টা শাড়ি সেল হলো। কিন্তু সমাজের বাধা যেন পার হতে পারছিলাম না। আমি মেয়ে, অনলাইন বিজনেস করলে বিপদে পড়তে হবে! এটা আমার কথা নয়, পরিবারের অন্য সদস্য ও পাড়াপড়শীর কথা। আমি জানি, ধৈর্য ধরলে সফলতা আসবেই। তাই দাঁতে দাঁত চেপে নিজের পথে এগিয়ে গেছি। নারীর পাশে নারীকে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। তবেই মিলবে নারীর মুক্তি। বরিশাল বিভাগীয় উদ্যোক্তা হাব আমার অ্যাক্টিভিটি দেখে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে তাদের সহপ্রতিনিধি করেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা শাহেদ জামান ভাইকে যোগ্য মনে করে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। এরই মধ্যে ৩ বার কোভিড পজেটিভ হই। ৩য় বারে মৃত্যুর দুয়ার থেকে যেন ফিরে এসেছি। আবার ব্যবসায় ভাটা পড়ে। তারপরও সব বাধা পেরিয়ে বরিশাল বিভাগীয় উদ্যোক্তা হাব, বরিশাল-গ্রুপে ৮ মাসেই লাখোপতির তালিকায় নাম লিখেছিলাম আমি। আমি একজন লাখোপতি সেটা ৮ মাস চেষ্টার ফল। ১ বছরে আমার অনলাইনে এখন পর্যন্ত বিক্রি প্রায় ২ লাখ টাকা। অনেকের কাছে হয়তো বেশি নয়, কিন্তু আমরা যারা নারী হয়ে স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখাই, তাদের জন্য এটা বড় বিষয়। চাকরি, সংসার, সন্তান সব সামলে সময় বের করে যতটা পেরেছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, এভাবেই অন্য নারীও এগিয়ে আসবেন। দাঁড়াবেন নিজের পায়ে।’
