দুদকের চার মামলা
রূপপুর প্রকল্পে বালিশ-কাণ্ডে মাসুদসহ ১৩ জন কারাগারে
গ্রেফতারের পর জামিন নামঞ্জুর
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশ-কাণ্ডে জড়িত গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনকে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিকালে আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী আসামিদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বৃহস্পতিবার দুদক কার্যালয় এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
এদিন দুপুরে ১৩ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আলাদা চারটি মামলা করে দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিন ও উপ-সহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ বাদী হয়ে পাবনায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এ মামলা করেন। প্রসঙ্গত রূপপুরে বালিশ-কাণ্ডের দুর্নীতি সংঘটিত হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নৈতিক কারণে এর দায় তিনি (সাবেক মন্ত্রী) এড়াতে পারেন না।
মাসুদ আলম ছাড়া গ্রেফতার অন্যরা হলেন- পাবনা গণপূর্ত উপবিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল কবির, মোস্তফা কামাল, শফিকুল ইসলাম, আহমেদ সাজ্জাদ খান, সুমন কুমার নন্দী, আবু সাঈদ, রওশন আলী ও তাহাজ্জুদ হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী তারেক, আমিনুল ইসলাম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আসিফ হোসেন ও সাজিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদত হোসেন।
দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে বালিশ-কাণ্ডের অনুসন্ধান করে দুদকের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম। তদন্ত শেষে গত সোমবার কমিশনে তারা মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। বৃহস্পতিবার তা অনুমোদন করে কমিশন।
আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী কেনাকাটার অনিয়মে ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রথম দফায় ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হল। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বালিশ-কাণ্ডে ৩৪ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে দুদকের অনুসন্ধান শেষে ১৩ জনকে আসামি করা হল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তকালে আসামি আরও বাড়তে পারে। আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান চালাই। তদন্তকালে যারা দোষী হবে তদন্ত শেষে তাদের সবার বিরুদ্ধেই চার্জশিট হবে।
রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বালিশ-কাণ্ডসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ১৭ অক্টোবর অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। ওইদিন কমিশনের উপ-পরিচালক মো. নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে সংস্থাটি।
রূপপুর প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মাণাধীন গ্রিন সিটি আবাসন প্রকল্পের ২০ ও ১৬ তলা ভবনের আসবাব ও প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা ও ভবনে উত্তোলন কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সেখানে একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, সেই বালিশ ফ্ল্যাটে ওঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়েছে। এভাবে রিফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, খাট, বিছানা, ওয়াড্রোব, বৈদ্যুতিক চুলা, বৈদ্যুতিক কেটলি, রুম পরিষ্কারের মেশিন, ইলেকট্রিক আয়রন, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি কেনাকাটা ও ভবনে তুলতে অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে।
জানা গেছে, রূপপুর গ্রিন সিটির মালামাল ক্রয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য কর্মকর্তা নিযুক্ত করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংঘটিত দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক মাঠে নামে।
এ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ে বাজারমূল্য থেকে বেশি দাম দেখানো হয়। অতিরিক্ত পরিবহন খরচ, তলাভিত্তিক উত্তোলন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি যোগ করে প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়
। কার্যাদেশ প্রদানের পূর্বে মালামাল গ্রহণ, সাজানো দরপত্র প্রকাশ ও কার্যাদেশ দেখিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধের নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনুসন্ধানী কর্মকর্তারা অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিশন এ প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে চারটি মামলা দায়ের করার অনুমোদন দেয়। এসব মামলায় ১৩ জনকে আসামি করা হয়। একজন ব্যক্তিকে একাধিক মামলার আসামি করায় চারটি মামলায় মোট ৩৩ জন আসামি দেখানো হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করতে গণপূর্ত অধিদফতরের কতিপয় প্রকৌশলী রূপপুর গ্রিন সিটির ২০ তলা ফাউন্ডেশনের ৬ ইউনিটবিশিষ্ট এক নম্বর ভবনের কিছু সিভিল এবং ই/এম ওয়ার্কসহ আইটেম কেনাকাটার ক্ষেত্রে বাজারমূল্য থেকে বেশি মূল্য দেখানো হয়।
অতিরিক্ত পরিবহন খরচ, তলাভিত্তিক উত্তোলন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি যোগ করে প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। কার্যাদেশ প্রদানের পূর্বে মালামাল গ্রহণ, সাজানো দরপত্র প্রকাশ ও কার্যাদেশ দেখিয়ে ঠিকাদারকে পরিশোধের নামে ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৪২ হাজার ৪৩৮ টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪১৮/১০৯ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর-৫(২) ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
প্রকল্পের ২ নম্বর ভবনের ৭৫টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৭ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৬৮ টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। প্রকল্পের তিন নম্বর ভবনের ৬৩টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮ হাজার ৭১৬ টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে একটি মামলা হয়।
প্রকল্পের চার নম্বর ভবনের ৯২টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৮ কোটি ১২ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫০ টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সব মিলিয়ে চারটি মামলায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে ৩১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
দুদক জানায়, দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মাণাধীন আবাসন প্রকল্পের আসবাবপত্রসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ ওঠার পর প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়। ওই ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। অনুসন্ধানে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়টি ধরা পড়ে।
বৃহস্পতিবার মামলায় আসামিপক্ষে গোলাম সারোয়ারসহ কয়েকজন জামিন শুনানি করেন। অপরদিকে দুদকের পক্ষে আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী আসামিদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর ওই আদেশ দেন। এরপর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
