একান্ত সাক্ষাৎকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত
আর্থিক খাত বাঁচাতে হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে
খেলাপি ঋণই বড় সমস্যা তৈরি করেছে * ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের সুযোগ নিচ্ছে আবার বাড়তি সুবিধাও নিচ্ছে, এটা চলতে পারে না * অর্থ পাচারে জড়িতদের খুঁজে বের করে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে * শাস্তি দেয়ার বিষয়টি ঘটবে কিনা, জানি না
মাহবুবুর রহমান রিপন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময়ের সাফল্য নিয়ে তিনি যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনই ব্যর্থতা নিয়েও তার রয়েছে মর্মব্যথা। বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থায় লুটপাট আর অনিয়মে ব্যবস্থা নিতে না পারায় যথেষ্ট আক্ষেপ রয়েছে তার।
কেন পারেননি, দেশের বর্তমান আর্থিক খাত ও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েই বা কী করণীয়- এসব নিয়েও তার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সিলেটে রোববার মুহিতের বাসায় তার সঙ্গে কথা বলেছেন যুগান্তরের সিলেট ব্যুরোর সিনিয়র রিপোর্টার মাহবুবুর রহমান রিপন।
যুগান্তর : দেশের বর্তমান অর্থনীতি কীভাবে দেখছেন?
মুহিত : অর্থনীতি তো ভালো অবস্থায় আছে এখনও। অর্থনীতির উন্নয়ন অগ্রযাত্রা হয়তো আরও দুই বছর থাকবে। কিন্তু এরপর কী হবে, সেটা বলা মুশকিল। সেটা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় যাবে এবং বিশ্বের সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্ট কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তার ওপর। এখনও এসব পরীক্ষা আমাদের নতুন মন্ত্রিসভার সামনে আসেনি।
যুগান্তর : নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে কি না?
মুহিত : অবশ্যই আছে। কেননা আন্তর্জাতিকভাবেই অবস্থান তেমন ভালো না। দেখবে, প্রজেকশন অব গ্রোথ প্রতিনিয়ত কমাচ্ছে আইএমএফ। সেগুলো চিন্তা করা প্রয়োজন। কেননা আমরা একটি উঠতি দেশ, এখানে একটু ভাটা পড়লেই বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
যুগান্তর : এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত কি না?
মুহিত : অবশ্যই নেয়া উচিত। অর্থ মন্ত্রণালয় হয়তো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। কেননা বাংলাদেশ যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সুতরাং তাদের পক্ষে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হবে না।
যুগান্তর : ব্যাংকিং সেক্টরে আজকের এমন দুরবস্থা কেন হল এবং কারা দায়ী বলে মনে করেন?
মুহিত : ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থায় নেই, সেটা সত্য। খেলাপি ঋণই বড় সমস্যা তৈরি করেছে। সেখানে কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা বছরের পর বছর চলছে। খেলাপি ঋণ কমাতে এখনই উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা নেয়া উচিত। এ অবস্থার জন্য দায়ী আসলে আমরা সবাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তা ছিল না। যারা সুবিধা নিয়েছে, তারা কখনোই উদ্যোক্তা ছিল না। তারা লুটপাট করতে এসেছিল। লুটপাট করে চলে গেছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য- সেটা বুঝেও বারবার তাদের সুবিধা দিয়ে গেছি। এজন্য আমিও কিছুটা দায়ী। এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল আমার। আমি পারিনি। কারণ আমার ভয়ংকর রকমের ভয় ছিল। একটি ব্যাংক বন্ধ করে দিলে দেশের জন্য খুব ক্ষতিকর হতো বলে মনে হয়েছিল। নিজের একটা অভিজ্ঞতা ছিল।
১৯৪৮-৪৯ সালে কমরেড ব্যাংক দেউলিয়া হয়, ওই সময়ে আমি ছাত্র। বৃত্তির টাকা থেকে সাইকেল কেনার জন্য আমার জমানো ১৪০ টাকা আর ফেরত পাইনি। খুব কষ্ট হয়েছিল। সেই অনুভূতি থেকেই ব্যাংক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। সেটা আমার ভুল ছিল। যেমন- ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল চোর ব্যাংক হিসেবে। যারা চোর ছিল, তারা প্রথমেই সব নিয়ে চলে গেছে। তারা কোনোভাবেই অভিযুক্ত হয়নি, খুব চালাকি করেছে। এই ব্যাংক বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম।
এখন মনে হচ্ছে, সেটা ভুল হয়েছে। কারণ, দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখন এই পর্যায়ে নেই যে একটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে অর্থনীতিতে ধস নামবে। এটা আসলে আমারই ভুল হয়েছে।
যুগান্তর : ব্যাংকের একশ্রেণির মালিক বা পরিচালকরাই বিপুল অঙ্কের বেনামি ঋণ তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন? এমন অভিযোগ এখন অনেকটা প্রতিষ্ঠিত। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
মুহিত : হ্যাঁ, সেটা হচ্ছেই। এটা বন্ধ করতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। খেলাপি ঋণের একটি শতাংশ যেটা হতে পারে- ৯ কিংবা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিতে হবে। এটার বেশি হলেই...। ব্যাংককে আর কোনো ব্যবসার সুযোগ দেয়া যাবে না। নিজের ব্যবসা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু করতে দেয়া হবে না। বন্ধ হয়ে গেলেও কোনো সুবিধা নয়। এমন সিদ্ধান্ত নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
যুগান্তর : ব্যাংক মালিকরা নিজের ব্যাংকের ঋণ নেয়ার কোটা শেষ করে অন্যান্য ব্যাংক থেকে ভাগাভাগি করে ঋণ নিচ্ছেন? সম্প্রতি সংসদে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা এভাবে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ তুলে নিয়েছেন। প্রশ্ন হল- তাদেরকে ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে কি এভাবে জনগণের আমানত ভাগাভাগি করে নিতে। আপনার মন্তব্য কী?
মুহিত : যারা এর জন্য দায়ী, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এসব দায়ী ব্যক্তিকে ব্যাংকের কোনো সহায়তা নয়। কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে, যাতে কোনো ব্যাংক থেকেই তারা সুবিধা না পায়। সব পথ বন্ধ করে দিতে হবে।
যুগান্তর : প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকদের অনেকেই মোটা অঙ্কের ঋণ দফায় দফায় পুনর্গঠন করে নিচ্ছেন। ফলে খেলাপি তালিকায় তাদের নাম আসছে না। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুহিত : এটা যে কোনোভাবে এখনই বন্ধ করতে হবে। এটা চলতে দেয়া ভুল। এসব ব্যাংকে একইভাবে খেলাপি ঋণের ৯ অথবা ১০ শতাংশের সীমা দিতে হবে। সীমা অতিক্রম করলেই অন্য ব্যবসা বন্ধ করে শুধু নিজের ব্যাংকের ব্যবসাই চালাতে হবে।
যুগান্তর : এই সিদ্ধান্ত নিলে তো প্রায় সব ব্যাংকই বন্ধ হয়ে যাবে?
মুহিত : বন্ধ হয়ে যাক। দেশে অনেক ব্যাংক আছে। এর মধ্যে ১০, ২০ কিংবা ৩০টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও কিছু হবে না।
যুগান্তর : ব্যাংকে ঋণ অবলোপনের মতো একটি ভয়াবহ অপরাধ কীভাবে জায়গা করে নিল। এছাড়া অবলোপনের নামে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই অবলোপনের মধ্যে ব্যাংক মালিকদের বেনামি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বিষয়টি নিয়ে হাই পাওয়ার কমিটি করে তদন্ত করা প্রয়োজন কি না?
মুহিত : ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের সুযোগ নিচ্ছে আবার বাড়তি সুবিধাও নিচ্ছে- এটা চলতে পারে না। সরকারের উচিত এখনই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঋণ অবলোপনের সুযোগ বন্ধ করা। এতদিন দেয়া হয়েছে, এখন আর নয়। অন্যদিকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত, তা না হলে এই সুবিধা চলতে থাকলে খেলাপি ঋণেই উৎসাহিত হবে।
যুগান্তর : বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনেকে এলসি ওপেন করে কোনো পণ্যই আনেননি। পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করেছেন। এসব ঘটনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোর প্রভাবশালী পরিচালকরা জড়িত। অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সার্ভার নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় একশ্রেণির হাইপ্রোফাইল ব্যাংক মালিক এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড অনেকদিন থেকে নির্বিঘ্নে করে আসছেন। মূলত এভাবে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
মুহিত : প্রথমেই যারা এলসির মাধ্যমে অর্থ পাচারে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে কালো তালিকাভুক্ত করা। তাদের নতুন করে এলসির সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া। সর্বোপরি ভালো ব্যবস্থা হবে- সবার জন্যই এ সুবিধাই বন্ধ করে দেয়া। যদিও একটু কঠিন হবে তবুও তাদের বলে দেয়া। এত বছর ধরে এই সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এখন আর নয়। এটাই হবে উত্তম পদ্ধতি।
যুগান্তর : বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিদেশে বিনিয়োগ করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিদেশে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, এমনকি মার্কেট কেনা থেকে শুরু করে সেকেন্ড হোমসহ নানা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। যাদের অনেকে ব্যাংকের মালিক, ব্যবসায়ী এবং সরকারের সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাদের এই টাকার উৎস্য কী এবং বিদেশে তারা কীভাবে এসব অর্থ নিয়ে গেলেন। এদের তদন্তের আওতায় এনে বিচার করার প্রয়োজন আছে কি না?
মুহিত : যারা বিদেশে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বানাচ্ছেন- এটা সম্পূর্ণ চুরি করেই করছেন। এই টাকা যেভাবে যায় সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এটা কালো টাকা। বহুবার কালো টাকা দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। যারা নেয়ার তারা এখনও নিচ্ছে। তাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল- বিশ্বের অনেক দেশ এতে সহায়তা করবে না। তবুও একটি উদ্যোগ নেয়া উচিত, যতটুকু সহায়তা পাওয়া যায়। তাতেই অনেকে ধরা পড়বেন।
যুগান্তর : অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আপনার উল্লেখযোগ্য সফলতা কী? পাশাপাশি যদি কেউ আপনার সময়কালের বড় কোনো ব্যর্থতার কথা জানতে চায় তাহলে উত্তরটা কী হবে? বিশেষ করে আজকের ব্যাংকিং খাতে যে অরাজকতা বিরাজ করছে তার কোনো দায় কি আপনার আছে?
মুহিত : আমার উল্লেখযোগ্য সফলতা হল- এখন আর বাংলাদেশে কেউ না খেয়ে মরে না। দারিদ্র্য বিমোচন লক্ষ্য ছিল, তা একটি পর্যায়ে চলে এসেছে- এটাই বড় সফলতা। অনেক সফলতা আছে বলেই ব্যর্থতা কিছুটা কম। তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অরাজকতায় ব্যবস্থা না-নেয়াটা ভুল ছিল, ব্যর্থতা নয়।
প্রশ্ন : ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট দমনে কোনো আক্ষেপ কি আছে, যে আপনি বহু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেননি?
মুহিত : আক্ষেপ তো থাকবেই। তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সেই আক্ষেপ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট দমনে আমি কিছুই করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, অবসরে যাওয়ার আগে একটি পরিকল্পনা দিয়ে যাব; কিন্তু সেটাও পারিনি। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ১০ বছরে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এমন একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম- এসব লুটপাট, দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। কারণ, যে জেনারেশন ঘুষে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই জেনারেশন কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমার পরবর্তী সময়ে যারা অর্থ মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন তাদের ওপর ছেড়ে দিয়েই অবসর নিয়েছিলাম।
যুগান্তর : রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট কেন প্রকাশ করা হল না? আপনিও চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি কেন?
মুহিত : রিজার্ভ চুরির সঙ্গে হাইলেভেলের একটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। যেমন: বড় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। যাদের কাছে সব দেশ টাকা রাখে। সুতরাং এই স্থানে এত বড় একটি চুরি হয়েছে এটা নিয়ে সবাই চিন্তিত ও লজ্জিত। কিন্তু বাংলাদেশের অসুবিধা হচ্ছে অনেক অর্থ হারিয়ে গেল। আমার মনে হয়, এখনও বাংলাদেশের কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে। যেমন: রিজাল ব্যাংকের মতো একটি ডাকাত ব্যাংক আর থাকা উচিত নয়। সারা বিশ্বে ব্যাংকিং ব্যবস্থা তৈরি হয় বিশ্বাসের ওপর। সেই বিশ্বাস তো রিজাল ব্যাংক রাখতে পারেনি। সুতরাং এই ব্যাংকটি আর বিশ্বের কোথাও থাকতে পারে না। সেই ব্যবস্থা এখনও বাংলাদেশ করতে পারে। শুধু এটা প্রমাণ করে যে, রিজাল ব্যাংক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তাই এটা বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করছে না। রিজাল ব্যাংক চালাকি করে সব দায় একটি মেয়ের ওপর দিয়েছে। মূলত পুরো ব্যাংকই এ চুরির জন্য দায়ী।
যুগান্তর : রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠাই কি ব্যাংক ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণ?
মুহিত : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায়ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়; কিন্তু আমাদের দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়। বেশিরভাগ মালিকই ব্যাংকার নন, কোনো অভিজ্ঞতাও নেই; কিন্তু দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাই তারা পেয়েছেন। আমাদের দেশে ব্যাংক পেয়েই তারা প্রভাবশালী হয়ে যান। তাদের আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উল্টো আরও শিথিল করা হয়। সেই কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। সেটা ঠিক হয়নি।
যুগান্তর : এখনও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আছে কি না?
মুহিত : অবশ্যই আছে। দেশের এখন যে অবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কোনো সমস্যাই হবে না।
যুগান্তর : চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনও এত ঋণ সরকারকে নিতে হয়নি। এতে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অশনিসংকেত দেখছেন কি না?
মুহিত : এটা ভালো লক্ষণ নয়। এভাবে ঋণ নিলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আরও প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। টাকার অবমূল্যায়ন হবে। জনকল্যাণের জন্য খুব খারাপ দিক হবে।
যুগান্তর : এভাবে ঋণ নেয়ার পেছনের কারণ কী থাকতে পারে?
মুহিত : সরকারকে নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ, গত তিন বছর রাজস্ব আদায়ে ফলস স্টেটমেন্ট দেয়া হয়েছে। তাই সরকার বাধ্য হয়েছে হয়তো। রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আদায় বাড়াতে যা করা প্রয়োজন তাই করতে হবে। ব্যাংক ব্যালেন্স দ্রুত কমাতে হবে।
যুগান্তর : ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে বাস্তবায়ন করতে খোদ প্রধানমন্ত্রী কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়ার পরও বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কারা দায়ী বলে আপনি মনে করেন?
মুহিত : ঋণের সুদের হার সরকার চাপিয়ে দিলে যেমন ঠিক থাকবে না, তেমনি বিনিয়োগকারীরা ১২ শতাংশ ঋণ নিয়ে ২০ শতাংশ মুনাফা করার পরিবেশও বাংলাদেশে নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নেমে এলে এটার সুফল পাওয়া যাবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নেমে আসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হলে আমানতের সুদের হার যেটা হবে সেটাই যে সর্বোৎকৃষ্ট, তা উপলব্ধি করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সারা বিশ্বেই মার্কেট পলিসি কঠিন। সিঙ্গেল ডিজিটে এলেই যে তা সঠিক হবে, তা এখনই কেউ বলতে পারবে না। তবে এটা নামানো প্রয়োজন।
যুগান্তর : রাষ্ট্রের স্বশাসিত সংস্থাগুলোর স্থিতিতে থাকা ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিকল্পনায় আইন করা হয়েছে, এটা কীভাবে দেখছেন?
মুহিত : এই কাজটি ভালো করেছে। কারণ, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে অন্যদিকে সরকারের ক্ষতি হবে, সেটা তো হয় না।
যুগান্তর : কখনও ক্ষুব্ধ হলে নেতিবাচক অর্থে আপনি প্রায়ই ‘রাবিশ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। রাবিশ যদি কোনো ব্যক্তি হয়, তাহলে ব্যাংকিংসহ পুরো অর্থনীতি সেক্টরে এই ‘রাবিশ’দের সংখ্যা কত শতাংশ?
মুহিত : না, এখানে এই শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এর জন্য আমরাও (সরকার) দায়ী। আমরা তো শুধু ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহ দিয়েছি, অনেক সুবিধা দিয়েছি। নয় বছর পর্যন্ত পরিচালক থাকতে পারবেন ইত্যাদি। লালনপালন অনেক করেছি। কিন্তু যাকে লালনপালন করা হয়, অন্যায় করলে তাকে শাস্তিও দিতে হয়। সেই কাজটি করতে পারিনি। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। শাস্তি দেয়ার বিষয়টি আদৌ ঘটবে কি না, তা আমি জানি না। এটা আমাদের সিস্টেমের ভুল।
