সিএজি’র নিরীক্ষা প্রতিবেদন: ১২ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম
ব্যাংকিং খাতেই সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা * এককভাবে বেসিক ব্যাংকের পৌনে ৪ হাজার কোটি টাকা * ২১টি মন্ত্রণালয়ে ৩৪টি অডিট সম্পন্ন
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্যাংকিং খাতসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ১১ হাজার ৭শ’ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম উদঘাটন করেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। এর মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে। আর এক বেসিক ব্যাংকেই পৌনে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ওপর পরিচালিত ৩৪টি নিরীক্ষায় অনিয়মগুলো শনাক্ত হয়েছে। বার্ষিক এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্প্রতি সিএজি থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়া হয়েছে।
আইন অনুযায়ী রিপোর্টগুলো প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতি আছে। রিপোর্টগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পর্যালোচনা করে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই অনিয়ম উদঘাটনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে সরকারের অডিট বিভাগ আগের তুলনায় সক্ষমতা বেড়েছে।
ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের অঙ্কের আকার থেকে বোঝা যায়, এ খাতে কত বড় দুর্নীতি ও অনিময় হয়েছে। এটি অনিয়ম মনে করে ফেলে রাখা যাবে না। এসব অনিয়ম সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আলোচনা করে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর এটি ফেলে না রেখে আলোচনায় আনা দরকার। তবে খেয়াল রাখতে হবে আলোচনা যারা করবে তাদের সঙ্গে কোনো সুবিধা লেনদেন হচ্ছে কিনা। তা না হলে আলোচনা বন্ধ থাকলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদন সূত্র মতে, এ বছর ১৮টি মন্ত্রণালয়ের ওপর ২৫টি নিরীক্ষা করা হয়। বিপরীতে আর্থিক অনিময় পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া ৮টি মন্ত্রণালয়ের ওপর ৯টি বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৬ হাজার ১৭১ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম উঠে আসে।
রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা, অডিটের সুপারিশ বাস্তবায়নে কম গুরুত্বারোপ, কার্যকর অভ্যন্তরীণ অডিটের অনুপস্থিতি, সুশাসনের ঘাটতি এবং বাজেট প্রাক্কলন ও বাস্তবায়নে সক্ষমতার স্বল্পতা রয়েছে।
যে কারণে একদিকে একই বিষয়ে অডিট পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অন্যদিকে অডিটের সংখ্যাও বাড়ছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর ২টি বিশেষসহ ৭টি নিরীক্ষায় আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়েছে ৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আছে ২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
তবে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মগুলো হয়েছে কয়েক ধরনের কৌশলে। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর খেলাপি হওয়া, শর্তভঙ্গ করে ঋণ গ্রহণ ও জাল এমেন্ডমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি ও পিসি সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে হয়।
এছাড়া ঋণ গ্রহীতাকে বিপুল অঙ্কের সুদ মওকুফ, মালামাল ঘাটতি ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ আদায়ে উদ্যোগী না হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
পাশাপাশি ঋণের অর্থ আদায়ে তদারকির অভাবে ক্ষতি, লোন অ্যাগেইনেস্ট ট্রাস্ট রিসিস্টে (এলটিআর) মঞ্জুরের পর পাওনা অর্থ আদায় না হওয়া, জামানত ছাড়া এলটিআর ঋণ মঞ্জুরের মতো অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া বন্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ে ব্যর্থ, অনাদায়ী ঋণের ওপর পুনরায় ঋণ ইস্যু, এলসির মাধ্যমে সৃষ্টি লিম অনাদায়ী অবস্থায় পুনরায় ঋণ ইস্যুর মতো অনিয়ম হয়েছে।
এদিকে বেসিক ব্যাংকের ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর ৫৬টি অনিয়ম শনাক্ত করা হয়। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এ প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকার অনিময় উঠে আসে রাজধানীসহ রাজশাহী, খুলনা ও চটগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। সেখানে বলা হয়, চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, রাস্তা বাস্তবের চেয়ে বেশি দেখিয়ে ঠিকাদারের বিল আদায়, চুক্তির চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় করে তহবিলে জমা না করা, ভবন নির্মাণে ঠিকাদারকে অনিয়মিত বিল পরিশোধের মাধ্যমে অনিময়গুলো করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত রাজউকের নিজস্ব বিধান, প্লট বরাদ্দের নীতিমালা ও সরকারি আদেশ পালন না করার কারণে এসব অনিয়ম হয়েছে।
১ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে কর্ণফুলী পেপার মিলে। চুক্তি ছাড়াই এই মিলের জমি বিসিআইসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। আবার সে জমির ভাড়া নেয়া হয়নি। এছাড়া সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস ব্যবহার না করে অধিক মূল্যের ফার্নেস অয়েল ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জরুরি প্রয়োজন দেখে যন্ত্রাংশ ক্রয়ের পর তা দীর্ঘদিন ফেলে রাখাসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে এ আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
এছাড়া প্রায় ৬৫৪ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির। অনিয়মগুলো হল- ওভারফ্লাইয়িং ও বকেয়া ল্যান্ডিং চার্জ আদায় না হওয়া, বোর্ডিং ব্রিজ চার্জ, রেন্ট ও ইউটিলিটিজ বকেয়া, লাঞ্চ ভাতা বাবদ অনিয়মিত ব্যয়। এছাড়া বিমানের টিকিট বিক্রির টাকা আদায়ে ব্যর্থতা, ভ্যাট আদায় না করা, বিমানে এবং উৎসে আয়কর ও ভ্যাট কর্তন না করার মতো অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এদিকে রাজস্ব খাতে অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে ২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার।
এর মধ্যে প্রকৃত রাজস্ব অপেক্ষা কম প্রদর্শন করে আয়কর কম ধার্য, অনুমোদনযোগ্য ব্যয় বিয়োজন করে মোট আয় কম নিরূপণ, অনুমোদনযোগ্য ব্যয়কে আয়ের সঙ্গে যোগ না করে মোট আয় নিরূপণ করার মধ্য দিয়ে ১ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম হয়েছে। পাশাপাশি প্রকৃত রাজস্ব পাওয়া থেকে কম দেখিয়ে নিট লাভ কম দেখানোর কারণে আয়কর ও সরল সুদ কম ধার্য করা হয়।
এছাড়া অতিরিক্ত প্রফিট ট্যাক্স প্রদান না করা, রেমিটেন্স মুনাফার ওপর আয়কর শোধ না করা, ব্যবসাবহির্ভূত আয়ের ওপর সাধারণ হারে কর আরোপ না করার মধ্য দিয়ে আরও ৮৬২ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। আর শুল্ক ভ্যাট কম দেয়াসহ নানা অনিয়ম হয়েছে ৭২৩ কোটি টাকার।
অন্য সব অনিয়মের মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের ৩৪ কোটি টাকা, সাবরেজিস্ট্রার অফিসে ২২ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে ৬৪ কোটি টাকা, সৌদি হজ অফিসে সাড়ে ৪ কোটি টাকা, বিদেশি দূতাবাসে প্রায় ৪ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলা ও বিপিসির ১৭ কোটি টাকা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন, জুট মিল কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬৪ কোটি টাকা, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ৩৩ কোটি টাকা, রেলওয়ের ২৪ কোটি টাকার অনিয়ম উঠে আসে।
