বড়পুকুরিয়া কেলেঙ্কারি: সাড়ে ৫ লাখ টন কয়লা লুট
ক্যাবের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ * আর্থিক ক্ষতি সাতশ’ কোটি টাকা * চুক্তির চেয়ে দ্বিগুণ- ১০.৫ শতাংশ পানিসহ কয়লা ক্রয়
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বড়পুকুরিয়ায় সাড়ে ৫ লাখ টন কয়লা আত্মসাৎ হয়েছে বলে দাবি করেছে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর তদন্ত কমিটি।
চুক্তিমূল্য অনুযায়ী এর দাম ৭০০ কোটি টাকার বেশি। কয়লায় সর্বোচ্চ পানির পরিমাণ থাকার কথা ছিল ৫.১ শতাংশ; কিন্তু চীনা ঠিকাদারের কাছ থেকে কয়লা কেনা হয়েছে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০.৫ শতাংশ পানিসহ। কমিটি জানায়, খনিতে এক দশমিক ৪৪ লাখ টন কয়লা চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল।
কিন্তু মামলা চলাকালীন অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিতে জ্বালানি বিভাগ চুরি যাওয়া কয়লাকে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হল। এ ঘটনায় দুদকের অভিযোগপত্রে বিসিএমসিএলের সাতজন এমডিসহ ২৩ জন অভিযুক্ত।
কিন্তু কমিটি মনে করে, ২৩ জনের সঙ্গে বিসিএমসিএলের শেয়ারহোল্ডার, পেট্রোবাংলা, জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারাও এই মামলায় অভিযোগভুক্ত হবেন। তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, কয়লা চুরির ঘটনাটি দুদক তদন্ত করেছে। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্ত্রী হিসেবে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তারপরও বলব, ক্যাবের এই প্রতিবেদনটি মামলাকে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, এই সংকট সমাধান করতে হবে। কেউ অন্যায় করে পার পাবে না। অন্যায়কারীর শাস্তি হবে।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত করছে। ক্যাবের এই তদন্ত প্রতিবেদন সেগুলোকেও সহায়তা করবে।
সম্মেলনে তদন্ত কমিটির প্রধান সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বড়পুকুরিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে দুর্নীতি বললে কম বলা হবে। এটি আসলে পুকুর চুরি ছাড়া আর কিছু নয়। যে কাজটি করা উচিত ছিল জ্বালানি বিভাগের, সেটি নাগরিকদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এখন সরকারের উচিত এই দুর্বৃত্তদের ছাড় না দেয়া।
তিনি বলেন, গোঁজামিল দিয়ে মানুষকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছে জ্বালানি বিভাগ। জাতীয় সম্পদ যারা চুরি করে, আর যারা এর বিচার করেন না, সেটাও বড় অন্যায়। ক্যাবের ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও বলেন, তাদের তদন্তে কয়লা চুরি সংক্রান্ত মোট ২৭টি অসংগতি উঠে এসেছে।
তার মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদ নষ্ট করার বড় উদাহরণ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি। এ জন্য দোষীদের আমরা শাস্তি চাই। এই চুরির বিচার না করা আরেকটা বড় অন্যায় হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ও তদন্ত কমিটির সদস্য শামসুল আলম বলেন, এর আগেও ৩০০ টন কয়লা চুরির একটি ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। এই ঘটনাটিও একইভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার সময় চলা প্রশাসনিক তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, শুধু সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, পরিচালনা বোর্ড, পেট্রোবাংলা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ব্যর্থ হয়েছে। জনস্বার্থে বিসিএমসিএলসহ সরকারি মালিকানাধীন সব কোম্পানির পরিচালনা নীতি ও আইনি কাঠামোর সংস্কার জরুরি। তিনি বলেন, মামলার বাদী বিসিএমসিএল নিজেই কয়লা চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্তদের পক্ষ নেয় এবং মামলাটিকে প্রহসনে পরিণত করে। এটি অন্যায় এবং সামঞ্জস্যহীন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও তদন্ত কমিটির সদস্য বদরুল ইমাম বলেন, পেট্রোবাংলার প্রস্তাবমতে, কয়লা সরবরাহের সিস্টেম লস ১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরে নিলেও আত্মসাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন অধ্যাপক এমএম আকাশ, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও প্রফেসর সুশান্ত কুমার দাস। তদন্ত কমিশনের সদস্য এমএম আকাশ বলেন, এখানে রক্ষক ভক্ষক হয়েছে, এটাই মূল বিষয়। একদম ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবার দায়িত্ব ছিল এটি সঠিকভাবে দেখা; কিন্তু সেটা এখানে করা হয়নি।
তদন্তে উঠে এসেছে, পর্যাপ্ত কয়লা না থাকা সত্ত্বেও এবং নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়। ফলে কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে কয়লা সরবরাহ না পাওয়ায় বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে কয়লা উধাওয়ের ঘটনাটি আলোচনায় আসে। সরকারের তরফ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং দু’জনকে বদলি করা হয়।
এরপর এ ঘটনায় একটি মামলা হলে তা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় গত বছরের ২১ জুলাই প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা চুরির অভিযোগে খনি কোম্পানির সাবেক সাত এমডিসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
১৯৯৪ সালে বিসিএমসিএলে উৎপাদনের শুরু থেকে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত সময়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে জানিয়ে ক্যাবের তদন্ত কমিশনের সদস্য বদরুল ইমাম বলেন, বিসিএমসিএল চীনা কনসোর্টিয়ামকে চুক্তি অনুসারে ৫ দশমিক ১ শতাংশ ‘ময়েশ্চার’ ধরে ওই সময় পর্যন্ত ১০১ দশমিক ৬৬ লাখ টন কয়লার বিল পরিশোধ করে।
কিন্তু তদন্ত কমিশনের হিসাবে ময়েশ্চার ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই হিসাবে কয়লার পরিমাণ হয় ১০৭ দশমিক ৩১ লাখ টন। বিসিএমসিএল কয়লা ব্যবহার ও বিক্রি করেছে ১০০ দশমিক ২২ লাখ টন।
সেই অনুযায়ী কয়লার ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক দশমিক ৪৪ লাখ টন। আমাদের তদন্ত কমিশনের হিসাবে ঘাটতি রয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যা আত্মসাৎ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার প্রস্তাবমতে, কয়লা সরবরাহে সিস্টেম লস গড়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই হিসাব ধরে নিলেও ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কয়লার ঘাটতি রয়েছে বা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
লিয়াজোঁ অফিসের নামে ঢাকায় অতিরিক্ত জনবল ও গাড়ি ব্যবহার করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, কয়লায় ময়েশ্চার পরিমাপে কারচুপি, একাধিক কমিটি করা হলেও সিস্টেম লস নির্ধারণ পদ্ধতি তৈরি না করা, এখতিয়ারবিহীন সুপারিশের ভিত্তিতে ডিওর মাধ্যমে কয়লাখনি এলাকায় কালোবাজার সৃষ্টি করাসহ অন্যান্য অসঙ্গতি পাওয়া যায় বলে জানান অধ্যাপক সুশান্ত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তদন্ত কমিশনের ৭৯ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন ক্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ক্যাব সেটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। পাশাপাশি সরকারের কাছে তা উপস্থাপন করা হবে।
তদন্ত কমিটির একজন সদস্য মনে করেন, বিসিএমসিএল চীনা ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে সিকিউরিটি মানি ১৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিনিময়ে তারা লাভবান হয়েছেন।
তার মতে, কথা ছিল চুক্তি শেষে ‘স্কোপ অব ওয়ার্ক’ অনুযায়ী সব ধরনের দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে ঠিকাদারকে এই টাকা দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তি লঙ্ঘন করে পুরো টাকা দিয়ে দিয়েছে বিসিএমসিএল। টাকা পরিশোধের আগে চীনা কনসোর্টিয়ামের বিভিন্ন বিল নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কোম্পানির ২৮৯তম পরিচালনা পর্ষদ সভায়ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোল ইয়ার্ডে মজুদকৃত কয়লার মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন চুরির বিষয়ে গঠিত কমিটিগুলোর দাখিলকৃত প্রতিবেদন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে প্রাপ্তির পর সুপারিশ মোতাবেক পরবর্তী বোর্ডসভায় এই টাকা দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।
কিন্তু তা না করে ১৯০তম সভায় চীনের ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামকে পুরো টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, চীনা ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও সেগুলো নিষ্পত্তি না করেই আগেভাগে তাদের সঙ্গে তৃতীয় দফায় চুক্তি করা হয়। বিসিএমসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান ১৮৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেন।
