করোনা চিকিৎসা: এখনও প্রস্তুত নয় হাসপাতাল
নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত সেবিকা ও চিকিৎসক * হৃদরোগ, নিউরো সমস্যা বা ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা নেই * সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে -পরিচালক হাসপাতাল
রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছে এক মাস আগে গত ৮ মার্চ। রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৪। কিন্তু এখনও আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় যথেষ্ট প্রস্তুত নয় হাসপাতালগুলো।
যেসব হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলোয় নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত সেবিকা ও চিকিৎসক। ক্রিটিক্যাল (মুমূর্ষু) রোগীদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নেই বিশেষ চিকিৎসক দল। প্রয়োজনে কোনো রোগীর হৃদরোগ, নিউরো সমস্যা বা ডায়ালিসিস করানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এ ধরনের রোগীদের সুচিকিৎসায় কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাও নেই। এমনকি কুর্মিটোলা হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে নেই পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালের প্রস্তুতি একেবারে নাজুক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা সংক্রান্ত সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে এখন মূলত বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে এ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। এর বাইরে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর লালকুঠি হাসপাতাল, রিজেন্ট হাসপাতাল উত্তরা ও মিরপুর এবং যাত্রাবাড়ীর সাজিদা ফাউন্ডেশনে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ক্রিটিক্যাল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। কিন্তু নির্ধারিত হাসপাতালের সব কটিতে এসব সুবিধা নেই। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতা আছে। ভেন্টিলেশন, আইসিইউর ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩টি হাসপাতালে ৫৫টি আইসিইউ শয্য থাকলেও এসব আইসিইউ পরিচালনায় বা রোগীদের পরিচর্যায় নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা আছে, হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোকে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, শুধু করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রাজধানীতে আটটি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে ঢাকা মেডিকেল, মুগদা জেনারেল, কুর্মিটোলা, সোহরাওয়ার্দী ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পৃথক শয্যা রয়েছে।
কুয়েত মৈত্রী ও কুমিটোলা হাসপাতালে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্য হাসপাতালগুলোয় শুধু আইসোলেটেড রোগীদের রাখা হবে। যাদের অধিকতর চিকিৎসা দরকার তাদের ওই দুটি হাসপাতালে নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যা বাকি আছে সেগুলো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার আপডেট তথ্য দেখা যায়, বর্তমানে রাজধানী ও এর বাইরের বিভিন্ন জেলার ৩৩টি হাসপাতালে আইসিইউ ভেন্টিলেটর রয়েছে ৩০০টি। নতুন করে সরবরাহ করা হচ্ছে আরও ১৩৪টি, মেরামত যোগ্য রয়েছে ৪৩টি। এ ছাড়া বিতরণযোগ্য আইসিইউ ভেন্টিলেটর রয়েছে ১৮৯টি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্যকর রয়েছে ৩০টি, সরবরাহ করা হবে আরও ২৫টি।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে বিদ্যমান ৪টি সরবরাহ করা হবে ৫টি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে ৬টি, কুমিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আছে ১০টি দেয়া হবে আরও ১২টি, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আছে ৯টি, দেয়া হয়েছে ১৬টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে ৮টি, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে আছে ২০টি, পঙ্গু হাসপাতালে আছে ৩টি, সরবরাহ করা হয়েছে ১২টি। এ ছাড়া জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট হাসপাতালে আছে ৩০টি। তবে সেগুলো শুধু হৃদরোগীদের জন্য। বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট হাসপাতালে আছে ১০টি।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ৪০টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর রয়েছে। সেগুলো শুধু নিউরো রোগীদের জন্য। ঢাকা শিশু হাসপাতালে আছে ১৪টি, শিশু রোগীদের জন্য। সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালে এতদিন কোনো আইসিইউ ভেন্টিলেটর ছিল না। সম্প্রতি সেখানে দুটি ভেন্টিলেটর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইন্সটিটিউটে দুটি আইসিইউ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরের লালকুঠিতে ২০০ শয্যার মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালকে (লালকুঠি হাসপাতাল) করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হবে। এটি মূলত পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের নতুন হাসপাতাল। এখনও সেভাবে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। করোনার চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ লোকবল দিয়েছে। তাদের সবাই এখনও যোগ দেননি।
ক্লিনার, আয়া বা সহায়তাকারী লোকবল নেই। হাসপাতাল সূত্র জানায়, এতে ২০০টি শয্যা আছে। তবে কোনো আইসিইউ ইউনিট নেই। ভেন্টিলেশনের সুবিধাও নেই। শ্বাসতন্ত্রের রোগী এলে কীভাবে ম্যানেজ করা হবে, কে ব্যবস্থা নেবেন- এসব এখনও ঠিক হয়নি। রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরায় দুটি শাখায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হবে। ৫০ শয্যার মিরপুর শাখায় এখনও চিকিৎসা শুরু হয়নি। তাদের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। অন্য হাসপাতালগুলোর একই অবস্থা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এর কোনো হাসপাতালে নেই ফিভার ক্লিনিক। অর্থাৎ কোনো রোগী চাইলেই হাসপাতালে যেতে পারবেন না। নমুনা পরীক্ষায় রোগী যদি পজিটিভ হয় আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়, তাহলে তিনি হাসপাতালের চিকিৎসা পাবেন। সম্প্রতি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দুটি বা তিনটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর মেশিন দেয়া হয়েছে। যেগুলো অপর্যাপ্ত। সবচেয়ে বড় কথা হলো এসব হাসপাতালে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত কোনো চিকিৎসক বা নার্স নেই।
যাদের মাধ্যমে রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা পাবেন। কুর্মিটোলা হাসপাতাল ছাড়া অন্য একটি হাসপাতালেও নেই কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যবস্থা। তাছাড়া এই হাসপাতালগুলোর একটিতেও নেই ডায়ালিসিস সুবিধা। নেই হৃদরোগীর কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা, নিউরো চিকিৎসা ব্যবস্থা। নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্যানেল। যারা কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে বোর্ড করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ঢাকার বাইরের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন যুগান্তকে বলেন, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য প্রশিক্ষণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, হাসপাতাল কাঠামোও গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরিবেশের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
