Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

করোনা চিকিৎসায় সমন্বয়ের ঘাটতি, দায়িত্ব পালনের পরও বরখাস্ত দুই চিকিৎসক

‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপাতে চিকিৎসক বরখাস্ত -বিএমএ * স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে -ডা. ইহতেশামুল হক

Icon

রাশেদ রাব্বি

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

করোনা চিকিৎসায় সমন্বয়ের ঘাটতি, দায়িত্ব পালনের পরও বরখাস্ত দুই চিকিৎসক

ফাইল ছবি

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা সমন্বয়ে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীরা ন্যূনতম চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

এসব রোগীর চিকিৎসায় নিবেদিত হাসপাতালগুলোয় যে চিকিৎসকদের বদলি বা পদায়ন করা হয়েছে, তাদের অনেকে যোগদান না-করে নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করছেন।

আবার যে সামান্য কয়েকজন চিকিৎসক রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তাদের প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। শুধু সমন্বয়হীনতার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে; কিন্তু এর দায়িত্ব কেউ নিচ্ছেন না-মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

তাদের মতে, আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী যে কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কাউকে নিয়োগ দেয়ার আগে তাকে ভালোভাবে বিষয়টি জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনেকে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে তাকে সময় দিতে হয়।

যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নিতে হবে, তাদের সাহস জোগাতে হবে। দায়িত্বে অবহেলায় কাউকে যদি শাস্তি দিতে হয়, তাহলে অবশ্যই সরকারি নিয়ম মেনেই শাস্তি দিতে হবে।

কিন্তু দেশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ঢাকতে অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের ‘বলির পাঁঠায়’ পরিণত করেছেন বলে তারা অভিযোগ করেন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক ৬ চিকিৎসকের বরখাস্তকে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর একটা কৌশল বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। সেখানে বলা হয়েছে, এই আদেশের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে চিকিৎসকদের বিব্রত করা হয়েছে। প্রশাসন অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সদ্য বরখাস্তকৃত আবাসিক চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ ফজলুল হক যুগান্তরকে বলেন, তিনি ওই হাসপাতালের করোনা চিকিৎসায় প্রথম থেকেই কর্মরত। প্রথম যে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, সেই মরদেহ সৎকারের সব প্রস্তুতিও তিনিই করেন।

তিনি মেডিসিনের এফসিপিএস হওয়ায় তাকে কো-ফোকাল পারসন হিসেবে হাসপাতালে করোনাভাইরাস কন্ট্রোল রুম ও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসকের থাকার জন্য নির্ধারিত ম্যাপল লিফ হোটেলে তিনি থাকেন।

তিনি কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে তার ফের কাজ শুরু হওয়ার কথা। তারপরও তিনি প্রতিদিনই হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের খোঁজ নিতেন এবং ব্যবস্থাপত্র দিতেন। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

বরখাস্তকৃত আরেক চিকিৎসক ডা. শারমিন হোসেন ফেসবুকে ভিডিওবার্তায় বলেন, তিনি ১ এপ্রিল থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ডিউটি করেছেন। ১৫ এপ্রিল থেকে আবার তার ডিউটি করার কথা। এর মধ্যে তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কেন তাকে সাসপেন্ড করা হল- জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক তাকে বলেন, এটা ভুলে হয়েছে।

কেন বরখাস্ত করা হল- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বেলাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশেই তিনি বরখাস্তের আদেশ দিয়েছেন। এই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দীন সচিবকে জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, শুধু সমন্বয়হীনতা নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে।

তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকার ও জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য দায়িত্ব পালনরত চিকিৎসকদের বরখাস্ত করেছে। এমনকি সরকারি নিয়ম অনুসারে কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে বরখাস্ত করতে হলে, তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়।

কিন্তু দু’জন চিকিৎসককে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে সেটিও করা হয়নি। তিনি বলেন, প্রথম শ্রেণির কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি বা পদায়ন এমনকি বরখাস্ত করার অধিকার স্বাস্থ্য অধিদফতর রাখে না।

এসব ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে সংরক্ষিত। এটা করলে মন্ত্রণালয় থেকেই করতে হবে। চিকিৎসকদের বরখাস্ত করার ক্ষেত্রেও সেই সরকারি নিয়মের বত্যয় হয়েছে। যাতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার দায় অধিদফতর এবং নিচের দিকের কর্মকর্তাদের ওপর চাপানো যায়।

ডা. ইহতেশামুল হক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে কেউ ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে অন্যত্র বদলি করতে হবে বা বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া যেতে পারে।

সম্প্রতি আমেরিকায় কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানকার ৬০ ভাগ ডাক্তার আতঙ্কিত হয়ে পড়নে ‘পেনিক ডিজঅর্ডার’ হয়ে পড়েছিলেন। এদের ধীরে ধীরে বুঝিয়ে কাজে আনা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি স্তরে সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

জানা গেছে, আইইডিসিআরের কয়েকজন টেকনোলজিস্টসহ বেশ কিছু কর্মী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গত ৪-৫ দিন চিকিৎসাধীন। পরিচয় প্রকাশ না করে এদের মধ্যে একজন যুগান্তরকে জানান, ভর্তির পর থেকে এ পর্যন্ত ওই হাসপাতালের কোনো ডাক্তার বা নার্স তাদের কাছে যাননি।

ইন্টারকমে ফোন করে নার্স ও ডাক্তাররা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। আর দরজার বাইরে খাবারের প্যাকেট রেখে তাদের খেয়ে নিতে বলেন। এমনকি ভর্তি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তারা যে কক্ষে আছেন সেই কক্ষটি পরিষ্কার করার জন্য কেউ আসেননি।

শুক্রবার রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী। ভর্তির পর তাকে একটি স্টোর রুমে ফেলে রাখা হয় এবং ওই দিন কোনো খাবার দেয়া হয়নি।

কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন ডাক্তার যুগান্তরকে বলেন, তিনি ভর্তির ছয় ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের কেউ তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। অর্থাৎ চিকিৎসক না থাকলেও একজন রোগীর কাছে নার্স আসার কথা-সেটি হচ্ছে না। এমনকি রোগীর অন্যান্য প্রয়োজনে ওয়ার্ডবয় বা আয়া থাকার কথা-সেটিও দেখা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক উপপরিচালক জানান, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসা যখন নির্ধারণ করা হয়, তখনই সেখানে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ছাড়া চিকিৎসকদের ডায়েটের জন্য আলাদা টাকা দেয়া হয়।

যাতে সেখানে কর্মরত চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা পোশাক এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব না পড়ে। কিন্তু শুরু থেকে ওখানকার ডাক্তাররা পিপিই নেই বলে জানান। এমনকি একটি এনজিও চিকিৎসকদের খাবার দিচ্ছে বলে প্রচার করছে। এরপর একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দীনকে ফোন করা হয়। তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত থাকায় কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।

এ বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, ওই হাসপাতালে শুরু থেকেই সমস্যা রয়েছে। সেখানে যে তত্ত্বাবধায়ক আছেন, তিনি এ ধরনের কাজে পারদর্শী নন। এরই মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করতে গিয়ে গর্ভবর্তী স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এই পরিস্থিতিতে তাকে ওখান থেকে সরিয়ে দক্ষ কাউকে দায়িত্ব দিতে বলেছি।

এদিকে গত ২৩ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব উম্মে রেহানা স্বাক্ষরিত এক আদেশে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের ১৬ জন চিকিৎসককে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে সংযুক্তি দেয়া হয়।

যেখানে বলা হয়: ২৬ মার্চের মধ্যে তাদের ওই হাসপাতালে যোগদান করতে হবে। পুনরাদেশ না-দেয়া পর্যন্ত তারা ওই কর্মস্থলে থাকতে হবে। জানা গেছে, এদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন, যারা এখনও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে যোগ দিলেও নিয়মিত কাজ করছেন না।

জানতে চাইলে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, যাদের সংযুক্তি করা হয়েছিল তাদের ১৩ জন ইতোমধ্যে যোগদান করেছেন। বাকি তিনজনের একজন মারা গেছেন। আর দু’জন বিদেশে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। তবে ওয়ার্ডবয় এবং ক্লিনার যাদের যোগদানের কথা ছিল, তাদের মধ্যে মাত্র ৩ জন যোগদান করেছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, করোনা চিকিৎসায় যেসব হাসপাতালকে কাজে লাগানো হয়েছে, সেগুলোয় চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে সবাইকে রোটেশনে দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে।

একাধিক গ্রুপকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে এখানে ব্যবস্থাপনার সমস্যা রয়েছে। তাই কোনো কাজে সমন্বয় হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতাল থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতেই বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব তথ্য আসে তার ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্ত দিই। যদি সেখানে ভুল করে কারও নাম এসে থাকে, তাহলে সেই আদেশ বাতিল করা হবে।

করোনা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম