শিল্পপতি ব্যবসায়ী নেতাদের প্রশ্ন: শিল্পঋণের কী হবে
বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি বিষয়ে শিথিলতা আরোপ করে পরিপত্র জারি করলেও শিল্পঋণ নিয়ে নিশ্চুপ * স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপৎকালীন ঋণের কিস্তি ও সুদারোপ স্থগিত করতেই হবে -মোহাম্মদ হাতেম * শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে এভাবে প্রটেকশন দিতে না পারলে অন্য সহযোগিতা কাজে আসবে না, প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা ব্যবসায়ীদের
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয়ে শিথিলতা আরোপ করলেও শিল্পঋণ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। অথচ অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে সবার আগে শিল্পঋণকে গুরুত্ব দিতে হবে। কঠিন এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মুখে যদি শিল্পমালিকদের শিল্পঋণের কিস্তি পরিশোধ ও সুদারোপের বোঝা থেকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব সবকিছুর ওপর পড়বে। বাস্তবে দেখা যাবে, সরকারের বিশেষ প্যাকেজসহ আর্থিক সেক্টরে দেয়া অন্যান্য সহায়তা কার্যত কাজে আসবে না। কেননা, কলসির ছিদ্র বন্ধ না করে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, কলসিতে পানি থাকবে না। চলমান সংকট মোকাবেলায় সরকারের জরুরি করণীয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকে যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন।
সোমবার এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করে যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে এখন সব বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই। ওনাকে তো সারা দেশ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কার্যত এখন সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই অর্থনীতি ও শিল্প সেক্টর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে যাদের পরামর্শ দেয়ার কথা, তাদের উচিত হবে শিল্পঋণের বড় সংকট নিয়ে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বলেন: প্রথমত, কোনো শিল্প স্থাপন করতে গেলে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেশিনারিজ স্থাপন করা নিয়ে ব্যাংক থেকে শিল্পমালিকরা শিল্পের আকারভেদে বড় অঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকেন।
এরপর দ্বিতীয় ধাপে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে নেয়া হয় মূলধনী ঋণ। এ দুটি ঋণ মিলে প্রতিটি শিল্পমালিককে নির্ধারিত সময়ে সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। যারা ভালো উদ্যোক্তা, তারা সব সময় নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে পুরো বিশ্ব এখন স্থবির। সব মিল-কলকারখানা বন্ধ। পৃথিবীর সামনে অতীতে এ রকম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর কখনও আসেনি। এই পরিস্থিতির মধ্যে ভবিষ্যতে শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা তাদের শিল্পগ্রুপের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের জনবলের বেতন-ভাতা দিচ্ছেন। মার্চ মাসের বেতন ইতোমধ্যে অনেকে পরিশোধ করেছেন।
প্রশ্ন হল- এরপর কী হবে? আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে এপ্রিল থেকে সবার বেতন-ভাতার দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে যেভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর এই ভালো উদ্যোগ কতখানি ভালোভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটি এখন দেখার বিষয়। তবে এখন সব কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে শিল্পমালিকদের নেয়া শিল্পঋণের কী হবে? সে বিষয়ে তো সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি। অথচ সবার আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা জরুরি।
কেননা, মিল বন্ধ অবস্থায় কোনো মালিকের পক্ষে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। স্বনামধন্য শিল্পগ্রুপও পারবে না। কেননা, বিদ্যমান অবস্থায় পৃথিবীর সব শিল্পপতিই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। মিল বন্ধ, উৎপাদন নেই, বিশ্বজুড়ে সবই লকডাউন। এ ছাড়া কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সে পূর্বাভাসও কেউ দিতে পারছেন না। ফলে এই অস্বাভাবিক অবস্থায় সরকারের উচিত হবে, শিল্পমালিকদের মানসিকভাবে স্বস্তি দিতে আপৎকালীন পুরো ঋণ কাঠামো স্থগিত রাখা। অর্থাৎ শিল্প-কলকারখানা পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখা। পাশাপাশি এ সময়ে শিল্পঋণের ওপর কোনো সুদারোপও করা যাবে না। এককথায় ঘরবন্দি সময়টাকে ব্যাংকের খাতা থেকে অবলোপন বা মুছে দিতে হবে।
তারা মনে করেন, সরকারের নীতিনির্ধারক মহল বিষয়টির সারবস্তু ভালোভাবে তুলে ধরতে পারলে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় অর্থ মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি দেশের শিল্পপতিদের এ আস্থা সব সময় ছিল এবং এখনও আছে। তিনি যেভাবে ৭৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ঠিক শিল্পঋণের বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দিয়ে আরও একবার ধন্য হবেন।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যবসায়ীদের সময় লাগবে। এই অবস্থায় ঋণের সুদ আপাতত স্থগিত রাখা উচিত। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক-উদ্যোক্তা পার্টনার। এই মুহূর্তে ব্যাংক যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখে, তাহলে পরবর্তী সময়ে তারা ব্যবসা করতে পারবেন। ব্যবসা করতে পারলে ঋণ ফেরত দিতে পারবেন। আর যদি মেরে ফেলে তাহলে সবারই ক্ষতি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ঋণের কিস্তি স্থগিতের পাশাপাশি সুদও স্থগিত করতে হবে। তা না হলে ব্যবসায়ীদের ওপর ঋণের বোঝা বাড়বে। বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে অনেক ব্যবসায়ীর পক্ষে সুদসহ ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকবে না। আর ঋণের সুদ স্থগিত করা না হলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ফায়দা ব্যবসায়ীরা পাবেন না। তাই শিগগির ঋণের ওপর সুদারোপ স্থগিত করে একটি ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, করোনার কারণে বিশ্ব এখন থেমে গেছে। কোথাও কোনো কার্যক্রম নেই। এ অবস্থা যতদিন চলবে ততদিন শিল্পঋণের ওপর সুদ স্থগিত করা উচিত। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে কোনো শিল্পোদ্যোক্তা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে আগামী জুন পর্যন্ত খেলাপি না করার নির্দেশ সব ব্যাংককে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপি যাতে না হয় সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে উদ্যোক্তারা যোগাযোগ রেখে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্যাকেজ সুবিধা নিতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি মন্ত্রণালয়ও পর্যবেক্ষণ করছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বহুমুখী প্রণোদনা ঘোষণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও ঘোষণা করা হবে। পরিস্থিতি দেখে পরে হয়তো আরও পদক্ষেপ নেবে সরকার। এখন অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকে যারা আমানত রেখেছেন, করোনার এই পরিস্থিতিতেও তাদের সুদ দিতে হবে। তাদের সুদ স্থগিত রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে ঋণগ্রহীতাদের সুদও স্থগিত করার সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছেন। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ৬টি প্যাকেজের বিষয়ে নীতিমালা ঘোষণা করেছে।
কিন্তু শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণের সুদের হার স্থগিত করা হয়নি। করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময়ে কারখানা বন্ধ থাকছে, মানুষের চলাচল নেই বলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি বা রফতানি করা যাচ্ছে না। ফলে উদ্যোক্তাদের অর্থ একদিকে নানা খাতে আটকা পড়েছে, অপরদিকে টাকার আয় বৃদ্ধির ক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায়। যে কারণে এ সময়ে ঋণের কিস্তি শোধ করা সম্ভব নয়; কিন্তু ব্যাংকগুলো বসে নেই। তারা তো নানামুখী সুদের হিসাব কষে যাচ্ছে। এতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে এই মন্দার পর সুদসহ ঋণের কিস্তি শোধ করা কঠিন হবে। এ জন্য অচিরেই শিল্পঋণের ওপর সুদারোপ স্থগিত রেখে একটি ব্লক অ্যাকাউন্টে নেয়ার দাবি করছেন উদ্যোক্তারা।
