Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বাড়বে সংক্রমণ তত কমবে

অধ্যাপক ড. আসিফ আহমেদ- ব্যাকটেরিয়া গবেষক

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বাড়বে সংক্রমণ তত কমবে

ফাইল ছবি

ভাইরাসের ধরন (টাইপ) পরিবর্তিত না হলে এবং এটি যদি ল্যাবে তৈরি ভাইরাস না হয়, তবে আগামী ১ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসতে পারে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশে তাপমাত্রা ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি সেসব দেশগুলোতেও সংক্রমণ কমবে। তবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি সহজে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না।

রোববার যুগান্তরকে এমন আশার বাণী শুনিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ আহমেদ। যিনি সক্রিয় ব্যাকটেরিয়া বিস্তার নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পিএইচডি গবেষণা করেন।

সম্প্রতি আংশিকভাবে প্রকাশিত আমেরিকার একটি গবেষণা প্রবন্ধ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমনটিই মনে করছেন এ গবেষক।

তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি- ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় করোনার লিপিড প্রোটিন পুরোমাত্রায় সক্রিয় থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বেশি হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ লিপিড দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সংক্রমণের গতি হ্রাস পায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রোটিন ভেঙে ভাইরাস পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

আমাদের দেশে মে মাসের শেষে এবং জুনের শুরুতে তাপমাত্রা এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। ফলে যথাযথভাবে লকডাউন মানলে আগামী দিনগুলোতে আমরা প্রকৃতির আশীর্বাদ পেতেও পারি।

সম্প্রতি আমেরিকার একটি গবেষণায় করোনাভাইরাসের ওপর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমকে গবেষকরা আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, উচ্চ তাপপাত্রা ও আর্দ্রতায় করোনাভাইরাস বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না।

অধ্যাপক ড. আসিফ আহমেদ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা গবেষণার ফলাফল বললেও মূল গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেননি। এটি উন্মুক্ত করে দিলে আমাদের মতো দেশগুলো হয়তো একটা বিকল্প খুঁজে পেত। তবে করোনা গোত্রের অন্য ভাইরাসগুলোর ওপর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাবের বিষয়ে সুস্পষ্ট গবেষণা আমাদের হাতে আছে। আমরা জানি, এ গোত্রের অন্য ভাইরাসগুলো উচ্চতাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়া টিকে থাকতে পারে না।

এখন বাংলাদেশে সংক্রমণের যে হারটা দেখছি তাতে এটা স্পষ্ট যে, এখানে কোথাও না কোথাও সংক্রমণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। জনঘনত্ব বেশি হওয়া সত্ত্বেও সংক্রমণের গতি ইউরোপ-আমেরিকার মতো নয়।

বিদ্যুৎগতিতে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হারে ছড়াতে পারছে না। আমরা এখন প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের পর থেকে ৫০ দিন পার করতে চলেছি। যদি ধরেও নিই এখানে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।

কিন্তু টেস্ট না করায় ধরা পড়ছে না। তারপরও বলতে হবে, করোনা এখানে সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। কারণ, যদি সংক্রমণ অনেক বেশি হতো তবে টেস্ট না করতে পারলেও দেশজুড়ে অনেক মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। আমরা কিন্তু সেটা এখনও দেখিনি।

বিচ্ছিন্নভাবে করোনা উপসর্গে যেসব মৃত্যুর কথা শোনা যাচ্ছে পরীক্ষায় তাদের ৯০ শতাংশের বেশি নেগেটিভ পাওয়া যাচ্ছে।

ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ কতটা আগ্রাসী হয় তা জানার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ এ ভাইরাস নিয়ে গোটা পৃথিবীতেই গবেষণা এখনও তেমন একটা জোরদারভাবে শুরু হয়নি। বিশ্বের সব গবেষণাগার এ নিয়ে চুলচেরা গবেষণার অনুমতিও দিচ্ছে না। জৈব নিরাপত্তার কারণেই করোনা নিয়ে গবেষণা খুব বেশি হচ্ছে না।

এ গবেষক বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সেখানে তাপমাত্রা বেশি থাকার পরও সংক্রমণ হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে- প্রথমত সেখানে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও বাতাসে আর্দ্রতা কম।

আরেকটি হচ্ছে প্রায় সর্বত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) ব্যবস্থা। ব্যাপক মাত্রায় এসি ব্যবহারের ফলে বাতাসে যেটুকু আর্দ্রতা থাকছে তাও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

ফলে শুধু তাপমাত্রা বেশি হলেই সংক্রমণ কম হবে, এটা বলা যাবে না। সংক্রমণ বাধাগ্রস্ত করতে হলে বাতাসেও প্রচুর আর্দ্রতা থাকতে হবে। সেটা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রচুর রয়েছে।

আমাদের দেশে মে মাসের শেষার্ধে বাতাসে আর্দ্রতা প্রায় ৯৫ শতাংশ পাওয়া যায়। এজন্য আমাদের সে সময়টা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। অন্তত মে মাসের পুরোটাই লাকডাউনে থেকে দেখতে হবে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়। কোনোভাবেই এ সময়ের আগে লকডাউন শিথিল করা যাবে না।

তবে আরেকটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে- এখন কিন্তু ঢাকার আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। এখন যেহেতু ঢাকায় মানুষের ঘনত্ব কম এবং গাড়িও চলছে খুব কম, সে কারণে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। অথচ বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে ঢাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। তাই এ ঠাণ্ডার কারণেও ঢাকায় করোনা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, তবে আমাদের দেশে সঠিকভাবে লকডাউন না মানার কারণে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের হার কমছে না। সামাজিক দূরত্ব না মানলে তাপমাত্রা যদি ৭০ ডিগ্রিও হয় তারপরও সংক্রমণ ছড়াবে।

যেমনটা আমরা নারায়ণগঞ্জে দেখতে পাচ্ছি। সেখানে আক্রান্ত মানুষ সংক্রমণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছেন। ফলে নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের অন্তত ৪০টি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

ভারতের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বি-টাইপের কোভিড-১৯ আক্রমণ করছে। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকায় সংক্রমণ হচ্ছে এ এবং সি টাইপের। যেটা সবচেয়ে মারাত্মকভাবে সংক্রামক।

তবে ঠিক কি কারণে আমাদের এখানে বি টাইপের সংক্রমণ হচ্ছে তা নির্ধারণের জন্য গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এটা কি আবহাওয়াজনিত কারণে, না প্রকৃতির আশীর্বাদ তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তবে একটা কথা বলা যায়, আমাদের এখানে করোনা এখনও ভয়াল থাবা বিস্তার করতে পারেনি। মানুষ যদি ঘরে থাকে তাহলে সংক্রমণের গতি অনায়াসেই কমানো সম্ভব। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে সংক্রমণ কোনোভাবেই কমবে না।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, কোনো দেশে একই সময়ে যখন একাধিক ভাইরাস সক্রিয় থাকে তখন শক্তিশালী ভাইরাসটি লিড করে (নেতৃত্ব দেয়)। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশে করোনা এখনও লিড শুরু করেনি।

যদি করত তাহলে সর্দি, জ্বরসহ করোনা উপসর্গের ৯০ শতাংশ রোগীর করোনা পজিটিভ পাওয়া যেত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এছাড়া আমরা প্রতিদিন সন্দেহভাজন পজিটিভ হিসেবে গড়ে সাড়ে তিন হাজার নমুনা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৫শ’ পজিটিভ কেস পেয়েছি।

করোনা লিড করলে এটা শতভাগের কাছাকাছি হওয়ার কথা।

অধ্যাপক ড. আসিফ আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারলে আমাদের দেশে মৃত্যুহারও কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ আমাদের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তরুণ এবং যুবক। কিন্তু উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও ইতালিতে মৃত্যু বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ, সেখানে সত্তরোর্ধ লোকের সংখ্যা বেশি।

এছাড়া পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মদ ও ধূমপানের অভ্যাস রয়েছে ব্যাপক। ফাস্টফুড বেশি খাওয়ায় উন্নত দেশে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। এসব কারণে সেখানে টাইপ-এ ও টাইপ-সি করোনা সর্বোচ্চ থাবা বসাতে সক্ষম হয়েছে।

এছাড়া আমরা লক্ষ্য করলে দেখব- আমেরিকা, ইতালি ও ফ্রান্সে এখন ঠাণ্ডা আবহাওয়া চলছে। গবেষণায় ইতোমধ্যে প্রমাণিত যে, করোনা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কারণ ঠাণ্ডায় করোনার লিপিড প্রোটিন সর্বোচ্চ সক্রিয় অবস্থায় থাকে। যেটা উচ্চতাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় অনেকটাই কমে যায়।

স্বাস্থ্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম