শ্রমিকদের সুরক্ষায় সব পক্ষের সদিচ্ছা জরুরি
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কল-কারখানা। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে যত কথা আসছে, তার মূল দাবি তিনটি। এর মধ্যে রয়েছে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি এবং আইনগত অধিকার নিশ্চিত করা। আরও এগুলো বাস্তবায়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সদিচ্ছা জরুরি।
যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, শিল্প মালিক এবং শ্রমিক নেতারা এসব কথা বলেন। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারি প্রণোদনা এমন প্রতিষ্ঠানকে দিতে যারা প্রকৃতই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন।
শ্রমিক নেতাদের দাবি, ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। আর তাদের অধিকার রক্ষায় সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আর শিল্প মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে তারা সচেতন রয়েছেন।
প্রকৃত উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে: মির্জ্জা আজিজ
বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ দুর্যোগ নিয়ে এসেছে করোনা মহামারী। চার মাস আগেও যা কারও ভাবনায় ছিল না। হঠাৎ করে পাল্টে দিয়েছে পুরো হিসাব। উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো শ্রমঘন শিল্পের জন্য পরিস্থিতি খুব কঠিন।
পরিস্থিতি উত্তরণ হলে বিনিয়োগ বাড়ে, এই ধরনের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া প্রণোদনা দেয়ার ক্ষেত্রে যারা যোগ্য, তাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
অর্থাৎ প্রকৃত উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেন।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। রাতারাতি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কারণ শ্রমিকের জন্য দরকার কর্মসংস্থান ও ন্যায্য মজুরি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গেলে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়।
আর কারখানা বন্ধ রাখলে শ্রমিক আয় আসবে কীভাবে। অপরদিকে পণ্য পরিবহন বন্ধ, বিপণন নেই। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কীভাবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানাও খোলা রাখার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো সব কারখানার নেই।
ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি খুব জটিল আকার ধারণ করেছে। তবে এই মুহূর্তে সবার আগে স্বাস্থ্য খাতে নজর দেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি উত্তরণ হলে আমাদের বাস্তবতার আলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে আলাদাভাবে পরিকল্পনা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব খাত প্রণোদনা চায়। তবে যে খাতে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেখানে প্রণোদনা দিতে হবে। পাশাপাশি যে খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। এরপর প্রণোদনা দিতে হবে।
অন্যদিকে আমাদের দেশে একবার প্রণোদনা শুরু হলে, তা কেয়ামত পর্যন্ত চলে। তাই যারা আসলেই প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য, তাদের বাছাই করে উৎপাদন সাপেক্ষে একটি সময়সীমা পর্যন্ত প্রণোদনা দিতে হবে।
এছাড়া বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, পরিস্থিতির উত্তরণ হলে বিনিয়োগবান্ধব কিছু কর্মসংস্থান হাতে নিতে হবে। কারণ পৃথিবীর সব দেশই উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে।
সব পক্ষই সচেতন : সিদ্দিকুর রহমান
এফবিসিসিআই সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, করোনার প্রভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বই বিপর্যস্ত। এ প্রেক্ষাপটে আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) যে পূর্ভাবাস দিয়েছে তার বাস্তবতা যাচাই সম্ভব নয়।
শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি ও শ্রমিকদের ওপর এর প্রভাব আরও বেশিও হতে পারে, কমও হতে পারে। তাই এখনই করণীয় ঠিক করা যাবে না। তবে বাংলাদেশ শিল্পঘন হওয়ায় এখানকার শ্রমিকদের ওপর তার প্রভাব বেশি পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষই এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। কীভাবে শ্রমিকদের ও শিল্প বাঁচিয়ে রাখা যায় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সিরিয়াস।
তিনি আরও বলেন, এই মহামারীর শেষ কবে তা কেউ বলতে পারছে না। এটি শেষ হলে শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থে সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করবে সরকার। তবে এই আপৎকালীন মুহূর্তে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে আস্তে আস্তে শিল্প খুলে দেয়া হচ্ছে।
মূলত শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও শিল্পের কথা চিন্তা করেই সরকার-ব্যবসায়ীরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরও শ্রমঘন দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে শ্রমিকদের ওপর বেশি প্রভাব পড়বে। সেটি কীভাবে লাঘব করা যায় সে বিষয়ে সরকার সজাগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে কারখানা খুলে দিয়েছে। এমনকি আগামী ৩ বছরে শ্রমিকদের জন্য কী করা হবে সেটিও ঠিক করে রেখেছেন।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সিরিয়াস। তিনি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে যদি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ক্ষুণ্নও হয় তারপরও তিনি শ্রমিকদের পক্ষই নেবেন।
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের শ্রম, ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি ও সরকারের নীতি-সহায়তার কারণে আজ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্বে জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই ৩টির মধ্যে একটিও অনুপস্থিত থাকলে শিল্প এই অবস্থায় যেতে পারত না।
বাংলাদেশের সব শিল্প মালিকই শ্রমিকবান্ধব। সব মালিকই শ্রমিকদের এবং শ্রমিকরাও মালিকদের অবদান স্বীকার করে। কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্য না থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু সহজ-সরল শ্রমিকদের ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে তৃতীয় পক্ষ ইস্যু তৈরি করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে।
নামধারী এই পক্ষটি ইচ্ছাকৃত ও অজান্তে দেশের শ্রমিকের ক্ষতি করছে। শ্রমিক দিবসে এদের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রমিকদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
পরিবহন শ্রমিকের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে : শাজাহান খান
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে পরিবহন খাতের ৫০ লাখ শ্রমিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবহনের ওপর লকডাউন দীর্ঘদিন থাকায় এত বিপুলসংখ্যক পরিবহন শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাস চলাচল বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শ্রমিক ইতোমধ্যে বেকার জীবনযাপন করছে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও পরিবহন মালিকদের থেকে টাকা নিয়ে তা দিয়ে শ্রমিকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই সহযোগিতা দীর্ঘদিন করা সম্ভব হবে না।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবহন শ্রমিকদের ত্রাণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক জেলায় শ্রমিকরা ত্রাণ পেলেও অনেক জায়গায় সেটুকুও পায়নি। জেলা প্রশাসকরা ত্রাণের যে চাহিদা দিচ্ছেন তা ত্রাণ মন্ত্রণালয় দিচ্ছে না। এতেও আমাদের অনেক শ্রমিক ত্রাণ পাচ্ছে না।
শাজাহান খান বলেন, লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে অনেক বাস মালিক ঋণের টাকা শোধ করতে পারবেন না। তখন গাড়ি কমে গেলে শ্রমিকও বেকার হয়ে পড়বে। অপরদিকে লকডাউন উঠে গেলে প্রথম পর্যায়ে মানুষের চলাচল বেশি থাকলেও ক্রমে তা কমে যাবে। আগের মতো মানুষের চলাফেরা থাকবে না।
এর ফলেও অনেক গাড়ি লোকসানে চলতে পারবে না। আর গাড়ি না থাকলে শ্রমিকও বাঁচবে না।
ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে পণ্যবাহী জাহাজ শ্রমিকরা : চৌধুরী আশিকুল আলম
পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও পণ্যবাহী জাহাজ সচল আছে। এসব জাহাজের শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন সচল রেখেছেন।
অথচ এসব শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি বা ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয়নি বলে জানান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, উল্টো দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব শ্রমিককে হয়রানি ও বঞ্চনা করা হচ্ছে। তারা কোথাও গেলে করোনাভাইরাস নিয়ে এসেছে- এমন সন্দেহে তাদের অবহেলা করা হচ্ছে। এমনকি বাজার করতে যেতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব সমস্যা তুলে ধরার পর কিছুটা সমাধান এলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
অপরদিকে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় সেসব নৌযানের শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের ভাতা থেকে বঞ্চিত। অনেক লঞ্চে ন্যূনতম মজুরিও দেয়া হয় না। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবে, তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে লঞ্চ চলাচল শুরু হলেও যাত্রী সংখ্যা কমে যাবে এমনটাই অনুমেয়। এতে অনেক নৌযান বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছি।
