করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা: সব ঋণের সুদ আরোপ ২ মাস স্থগিত
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার জারি : ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর সব ঋণের সুদ ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে * পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব সুদ গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না * প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের ওপর দুই মাসের সুদ আরোপ স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। এর আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সার্কুলারটি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সূচনা বক্তব্য দেয়ার সময় বলেন, বিদ্যমান করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু স্থবির হয়ে আছে। তাই ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
কীভাবে এর সমাধান করা যায়, সেটি আমি দেখব। একই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সার্কুলার জারি করা হয়।
এদিকে সার্কুলার জারির পর ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকে ফোনে যুগান্তরের কাছে তাদের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, এর ফলে কিছুটা হলেও তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। তবে সুদ একেবারে মওকুফ করে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা প্রয়োজন হবে। তা না হলে তারা ক্ষতি সামাল দিতে পারবেন না।
সার্কুলারে বলা হয়, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর এই দু’মাসের সব ধরনের ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ বা মুনাফা আরোপ স্থগিত করতে হবে। ওই ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর আরোপিত বা আরোপযোগ্য সুদ বা মুনাফা একটি সুদবিহীন ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে।
পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব সুদ বা মুনাফা গ্রাহককের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্লকড হিসাবে স্থানান্তরিত সুদ বা মুনাফা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সে ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলোকে জানানো হবে।
এসব সুদ বা মুনাফা কোনোক্রমেই ব্যাংকের আয় খাতে নেয়া যাবে না। ইতোমধ্যে কোনো ব্যাংক এসব সুদ বা মুনাফা ব্যাংকের আয় খাতে নিয়ে থাকলে সেগুলো পুনরায় ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে।
উল্লেখ্য, সাধারণ ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণ দেয়, এর বিপরীতে সুদ আরোপ করে। ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের অনুকূলে বিনিয়োগ করে, এর বিপরীতে তারা মুনাফা আদায় করে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে টানা লকডাউন চলছে। লকডাউন প্রায় ৪০ দিন পার হয়েছে।
এর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মকাণ্ডও স্থবির। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ থাকায় উদ্যোক্তাদের কোনো আয় হচ্ছে না, বরং অফিস ভাড়া, কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদানে ব্যয় হচ্ছে।
এদিকে ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছেন তার বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ আরোপ করে যাচ্ছে। ফলে সুদের অঙ্ক বাড়ছে। আয় না থাকায় এসব সুদ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ কারণে উদ্যোক্তারা দাবি করে আসছেন- গত মার্চ থেকে কমপক্ষে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ সুদ আরোপিত হবে, সেগুলো স্থগিত রেখে তা মওকুফ করার জন্য। তাহলে চলমান মন্দার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।
কেননা, করোনার প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। গত মার্চের শুরু থেকেই বাংলাদেশের ভেতরে করোনার প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যায়। ফলে নেতিবাচক প্রভাবটা মার্চ থেকেই প্রকট আকারে পড়তে শুরু করেছে।
এ কারণে সুদ আরোপ স্থগিত ও মওকুফ করার বিষয়টি মার্চ থেকেই ভাবতে হবে। এ পরিস্থিতির অবসান হবে কবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশি দিন স্থায়ী হলে ক্ষতিও বেশি হবে। এ কারণে আপাতত ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের বিপরীতে সুদ আরোপ যেমন স্থগিত করতে হবে, তেমনি এগুলো মওকুফ করতে হবে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে অন্যভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার প্রণোদনা দিতে পারে।
বর্তমানে বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোকে মোটা অঙ্কের তহবিলের জোগান দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক কমে যাবে। ব্যাংকগুলো গড়ে ৪-৭ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে।
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে ১-৪ শতাংশ সুদে। ফলে তহবিল পেতে তাদের খরচ অনেক কমে যাচ্ছে। এভাবেও ব্যবসায়ীদের আলোচ্য সময়ের সুদ মওকুফের ক্ষতি মেটানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত ও গতিশীল রাখার লক্ষ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ সার্কুলারের ফলে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো কোনো ঋণের বিপরীতে সুদ আরোপ করতে পারবে না। ওই সময়ের সুদ হিসাব করে ব্যাংকের একটি ব্লকড অ্যাকাউন্টে নিয়ে রাখতে হবে। ওই হিসাবে এ সুদের ওপর কোনো সুদ আরোপিত হবে না। ফলে উদ্যোক্তারা আপাতত দুই মাসের সুদ আরোপ এবং এ সুদ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে আরোপিত দণ্ড সুদ থেকেও রেহাই পেলেন।
