হিসাব মেলাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে, বাড়ছে ব্যয়ের খাত কমছে আয়
ঘাটতি মেটাতে দেশীয় ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাস অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। আগামী বাজেটের হিসাব মেলাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। মহামারীর প্রভাবে আমদানি-রফতানিতে শ্লথগতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় এবারই প্রথম রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ধাক্কা সামাল দিতে প্রচলিত ব্যয় খাতের বাইরে আরও অনেক নতুন নতুন খাত যুক্ত হচ্ছে।
এ অবস্থায়ই উচ্চ প্রবৃদ্ধির বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার, যা আগামী ১১ জুন সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে কোনো খাতেই আয়ের পরিমাণ বাড়ানোর মতো ইতিবাচক অবস্থার দেখা মিলছে না। নানামুখী হিসাব-নিকাশ করেও ব্যয়ের তুলনায় বাড়ানো যাচ্ছে না আয়ের পরিমাণ।
বিভিন্ন খাতে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, তার বিপরীতে আপত্তি উপস্থাপন করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এতে বাজেটের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেটের হিসাব মেলানো হচ্ছে।
ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এবার সরকারি বিভিন্ন বন্ড ও বিল শেয়ারবাজারে বিক্রি করে ঋণ নেয়ার নতুন খাতও চিহ্নিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
হিসাবমতে, মোট রাজস্ব আদায়ের ৮৬ শতাংশের বেশি জোগান দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর বাইরে এনবিআরবহির্ভূত কর ও কর ব্যতীত খাত থেকে আসে ১৪ শতাংশ। রাজস্ব আয় মোট বাজেটের ৭২ ভাগ। বাজেটের বাকি ২৮ শতাংশ থাকে ঋণ নির্ভর।
এবার করোনার কারণে এনবিআর ও এনবিআরবহির্ভূত প্রধান দুই খাতেই রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে। সরকার এখন চলছে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা দিয়ে। আগামী অর্থবছরেও অর্থনীতি খুব বেশি সচল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ কারণে প্রধান দুই খাত থেকেই আয় কম হওয়ার আশঙ্কা করছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এদিকে করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে নানামুখী প্যাকেজের আওতায়ও ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে, যা প্রত্যাশিত ছিল না। ফলে সরকারের ব্যয়ের চাপ বেড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাত থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এত রাজস্ব আদায় নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় প্রকাশ করেছে এনবিআর।
এ বিষয়ে সম্প্রতি এনবিআর থেকে অর্থ সচিবকে একটি চিঠিও দিয়েছে। সেই চিঠিতে রাজস্ব আদায়ে করোনার নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
এনবিআরের ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কম।
স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। এদিকে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা। দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা অসম্ভব বলে বিবেচনা করা যায়।
এতে আরও বলা হয়, আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে দুর্যোগ পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হতে শুরু করে তাহলেও স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থনীতির ওপর রেখে যাওয়া বিপুল প্রতিক্রিয়ায় আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না। তথাপি বর্তমান বছরের সম্ভাব্য রাজস্ব আদায়ের ওপর পূর্ববর্তী গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হিসাব করা হলে আগামী অর্থবছরের সর্বমোট আহরণ ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না মর্মে পরিসংখ্যানভিত্তিক ধারণা করা যায়।
অপরদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আদায় দুরূহ হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত দশ মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি থাকছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ও দেশীয় উৎস থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে ঋণ দেয়া হলেও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সরকার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ইতোমধ্যে ঋণ নিয়েছে। ঋণের মাত্রা আরও বাড়ানো হলে ব্যাংকের ওপর চাপ পড়বে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ধারাবাহিকতা ও সুনাম ধরে রাখার জন্য ঋণনির্ভর বড় বাজেট না করে ছোট করা উচিত। এতে বাস্তবতা প্রতিফলিত হবে। বাস্তবতার বাইরে গিয়ে অঙ্কের হিসাব মিলিয়ে বাজেট করলে তা যেমন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তেমনি বাস্তবের সঙ্গে হিসাবও মিলবে না।
এদিকে বাংলাদেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ পাওয়া যায় বৈদেশিক অনুদান। যেসব দেশ অনুদান দেয় ওইসব দেশে এখন করোনার মহামারী চলছে। যে কারণে ওইসব দেশ থেকে অনুদান পাওয়ার পরিমাণও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে করোনার কবল থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া হবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার থেকে দিয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া করোনার কারণে স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ওষুধ ও স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি আমদানি বাড়াতে হয়েছে। এ খাতেও বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য, ভর্তুকি, প্রণোদনা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। যা প্রত্যাশিত ছিল না।
