চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৮.২ শতাংশ
জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ: সিপিডি
আগামী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব * চলতি অর্থবছরে রাজস্বে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে * স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি ও কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাসে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। এতে ৫টি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ও যোগাযোগ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা। এতে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এবার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি অর্জন হবে না। এছাড়া দরিদ্র ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ইতোমধ্যে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেড়েছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। এ অবস্থায় বাস্তবতার আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে রোববার এসব কথা বলা হয়। সেখানে আরও বলা হয়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। এছাড়া আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। যা একেবারে অসম্ভব।
ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তারা আগামী বাজেটে ৪টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন। এগুলো হচ্ছে- স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি এবং কর্মসংস্থান। এছাড়া রাজস্ব খাতের জন্য ৪টি সুপারিশ করেছে সিপিডি। এর মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব আহরণে প্রণোদনা, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, করফাঁকি ও অর্থপাচার রোধ এবং এ খাতের প্রয়োজনীয় নিশ্চিত করা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে, তা আমরা কেউ জানি না। এমনকি বিজ্ঞানীরাও বলতে পারে না। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। তিনি বলেন, করোনার সময়ে দেশে বৈষম্য আরও বাড়ছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ও দেশের বাইরের খাত অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। তবে বাজেট অর্থায়নের এক্ষেত্রে এবার বৈদেশিক খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকার বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য ইতোমধ্যে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা দিয়েছে। এই অর্থ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আর প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু এবার এটি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে রাখলেও সমস্যা নেই।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলছেন, আমরা এ বছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছিলাম। প্রথম নয় মাস অর্থনীতি খুব ভালো চলেছে। সুতরাং আমাদের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতেই পারে। তবে আমাদের হিসাবে ২ থেকে আড়াই শতাংশের বেশি হবে না। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এটি একেবারে অসম্ভব। কারণ স্বাভাবিক সময়ে রাজস্ব আয়ে প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে সব খাতে যেখানে আয় কমছে, সেখানে কীভাবে এই প্রবৃদ্ধি হবে, তা বুঝে আসে না। এছাড়া দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পক্ষে মত দেন তিনি। ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি কমাতে না পারলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এ সময়ে বাজেটে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।
তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মার্চের শেষদিক থেকে অর্থনীতি একটা ভিন্ন গতি-প্রকৃতিতে চলে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন হতে পারে আমরা সেটা দেখার চেষ্টা করেছি। সেক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বর্তমান যে পরিস্থিতি আছে তার কী ধরনের প্রভাব পড়েছে। এক্ষেত্রে ৫টি খাত বেশি সমস্যায় পড়েছে। তিনি বলেন, জিডিপিতে ১৫টি খাত থাকে। এর অধিকাংশই ক্ষতিতে পড়েছে। তবে কৃষি ওইভাবে প্রভাবিত হয়নি। কৃষির উৎপাদন মোটামুটি ভালো।
তিনি বলেন, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা যদি ধরে নিই অর্থবছরের বাকি যে সময় আছে তাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে, তারপরও প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি সম্ভব নয়। অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিও যদি আমরা এই বছরের জন্য চিন্তা করি, তাহলে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। তিনি বলেন, এই অর্জনও যথেষ্ট খারাপ নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এই সময়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে। ভারতেও এই ধরনের আশঙ্কা করা হয়েছে। তার মতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ প্রবৃদ্ধি সবকিছু নয়। আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রবৃদ্ধি গুরুত্ব দেন। কিন্তু বর্তমান সময় অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের সময়। এই সময়ে আমরা প্রবৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর না দিয়ে, বরং আমাদের মানুষের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি অবশ্যই এবারের জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামক হতে পারে না।
করোনার কারণে আমাদের দরিদ্রতার হার অনেক বেড়েছে। আগে আমাদের দরিদ্রের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর ইতোমধ্যে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, তারা কবে ফিরে আসবে, তা অনিশ্চিত। সিপিডির এই গবেষক বলেন, তিনি বলেন, পুরো বছরই আমাদের সম্পদ সংগ্রহ, ব্যাংকিং খাত এবং পুঁজিবাজার অত্যন্ত সমস্যায় ছিল। এরপর অর্থায়নের জন্য সব জায়গা থেকেই ব্যাংকের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই টাকা দেয়ার জন্য ব্যাংকিং খাত প্রস্তুত কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। তার মতে, লকডাউনের মধ্যে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ বাড়ছে না। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ অর্থ ইতোমধ্যে সরকার নিয়েছে। আগামী অর্থবছরেও এই মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাবে না। এতে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। তবে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার পরামর্শ দেন তিনি।
তৌফিকুল ইসলাম খান আরও বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা এবং ন্যূনতম কর হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা উচিত। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ওইভাবে বাড়বে না। কারণ মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে সঞ্চয় কমবে। এতে সামগ্রিকভাবে সরকারের অর্থায়ন চ্যালেঞ্জে পড়বে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনিক দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
