অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অভিমত
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব অর্জন অসম্ভব
বাজেটে যে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা পুরোপুরি অবাস্তব -ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম * জিডিপি অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত ছিল -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ * রফতানি আয় না বাড়লে প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে -আবদুস সালাম মুর্শেদী
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চলমান করোনাভাইরাসে দেশের আর্থিক মন্দা কতটা প্রকট হয়েছে, তা প্রকাশ পেয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার কমে যাওয়ার মধ্যদিয়ে। বিবিএসের প্রাথমিক হিসাবে চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার পর থেকে সর্বনিম্ন। এই মুহূর্তে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখী। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার বেশি মাত্রায় নির্ভর হচ্ছে ঋণের ওপর। এমন প্রতিকূলতার মধ্যেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বাজেটে যে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা পুরোপুরি অবাস্তব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বড়জোর ৪-৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার থাবা কতদিন স্থায়ী হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই থাবার প্রভাব বন্ধ করতে না পারলে অর্থনীতিও গতিশীল হবে না। নতুন অর্থবছর শুরু হতে বাকি আছে ২১ দিনের মতো। এই অবস্থায় করোনার বড় ধাক্কা নতুন অর্থবছরেও আসবে এবং এগুলো সামাল দেয়ার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, যৌক্তিক কারণেই আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব ও অর্জন অসম্ভব। তারা বলছেন, করোনার ভয়াল থাবার কারণে বাংলাদেশের শিল্প সেক্টর ও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই যেখানে কঠিন হয়ে পড়বে, সেখানে এমন অবাস্তব প্রবৃদ্ধি শুধু কাগুজে স্লোগান ছাড়া কিছুই না। পাশাপাশি এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণার যে প্রস্তুতি চলছে, তা অর্জন করা অলীক স্বপ্নের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ অতি উচ্চাভিলাষী। করোনার কারণে যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির, সেই অবস্থায় জিডিপির এই হার অর্জন করা সম্ভব হবে না। চলতি অর্থবছরের জিডিপি অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত ছিল। এ বছর যদি আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, তবে তার চেয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে কখনোই এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে। সরকারি হিসাবে প্রবৃদ্ধি যদি সাড়ে ৫ শতাংশ অর্জিত হয় তাহলেও আগামী অর্থবছরের জন্য বেশি ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন ও জিডিপি অর্জন হারের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ও জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হলে সব খাতের জন্য ইতিবাচক হবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে এ তথ্য মানতে নারাজ দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। তাদের মতে, প্রবৃদ্ধির হার আরও অনেক কম হবে। তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে গবেষণা করে জিডিপির ভিন্ন হিসাবও প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের খ্যাতিমান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার আড়াই শতাংশের বেশি অর্জিত হবে না। বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস গ্রুপ বলছে, এ হার কোনোক্রমেই ২ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশের বেশি হবে না। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ হার ২-৩ শতাংশের মধ্যে থাকবে। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি হওয়ায় বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও বড় সংশয় দেখা দিয়েছে। রাজস্বের ঘাটতি পূরণ করতে সরকার ব্যাংক ঋণের ওপর জোর দিয়েছে। ফলে ব্যাংকের ওপর চাপ বেড়েছে। এর মধ্যে আবার করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকগুলোয় চাপ আরও বেড়েছে। তাছাড়া ব্যাংকের কাছে টাকা না থাকলে দেবে কোথা থেকে। উপরন্তু, সরকার যদি বেশি মাত্রায় ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কীভাবে হবে। বিষয়টি সরকারের বেসরকারি বিনিয়োগ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অথচ আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। উল্টো প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চলতি অর্থবছরের সমহারে অর্থাৎ ৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে ১৭ শতাংশ।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এটি অর্জন করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ, স্বাভাবিক সময়ে রাজস্ব আয়ে প্রতিবছর ১৪-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে সব খাতে যেখানে আয় কমছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে, সেখানে কীভাবে এই প্রবৃদ্ধি হবে, তা বুঝে আসে না। তিনি জানান, দেশের নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস অর্থনীতি খুব ভালো চলেছে। শেষ তিন মাস খারাপ গেছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশের পরিবর্তে ৬ শতাংশ অর্জিত হতেই পারে। তবে সিপিডির হিসাবে ২ থেকে আড়াই শতাংশের বেশি হবে না।
চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে। এ বিশাল ঘাটতি মাথায় নিয়ে আগামী অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, যা একেবারেই অসম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে শিল্প খাত। বছরের শুরু থেকে এ খাতে নানা সংকট দেখা দেয়। করোনার প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই এ খাতটি ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এখন আরও ভয়ানক রূপ নিয়েছে। গত মার্চ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ভোক্তারা নিত্যপণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য কেনাকাটা করছে না। এতে নিত্যপণ্য ছাড়া শিল্প খাতের সব পণ্যের বেচাকেনা প্রায় বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ কবে নাগাদ ঘটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অবাস্তব হয়ে পড়বে-এমটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি এবং সরকারি দলের সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, করোনার প্রভাবে রফতানি বাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দেশের উৎপাদন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। ফলে রফতানি আয় আগের মতো আর বাড়ানো সম্ভব নয়। রফতানি আয় না বাড়লে প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
