করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় বিশ্লেষকদের অভিমত
বিনা শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে অপ্রদর্শিত অর্থের
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাসে অর্থনীতির ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবেলায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। যার অন্যতম সমাধান দিতে পারে অপ্রদর্শিত অর্থ। তবে এ টাকা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে বিনা শর্তে। শর্ত আরোপ করে কোনো লাভ হবে না। অতীতেও হয়নি। শর্ত দিলে কেউ টাকা বের করবে না।
মনে রাখতে হবে, একমাত্র দুর্নীতি-জালিয়াতি ছাড়া এসব অর্থের একটি বড় অংশ বৈধ। কিছু বিধিবিধানের প্রতিবন্ধকতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে তার বৈধ অর্থও আয়কর নথিতে প্রদর্শন করতে পারে না। তাই করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আগামী বাজেটে এ বিষয়ে বড় ধরনের সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্তত ৫-৭ বছরের ট্যাক্স হলিডে ঘোষণা করতে হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ করার প্রশ্নে মঙ্গলবার যুগান্তরকে এমনটিই জানিয়েছেন কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা, বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ৩ পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালো টাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালো টাকা বিনিয়োগ করা যায়। শুধু আবাসন খাতের জন্য ১৯বিবিবিবিবি নামে আয়কর অধ্যাদেশে আলাদা একটি ধারা আছে। এ ধারা অনুযায়ী, এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা যায়। ১৯ডিডি ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে এনবিআর অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না। তবে আয়ের উৎস সম্পর্কে সরকারের অন্য সংস্থার প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। তাই দীর্ঘদিন এমন সুযোগ দেয়া হলেও কালো টাকা বিনিয়োগে আসছে না। উল্টো দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ছে।
আগামী বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আনতে নতুন আরেকটি সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আয়কর অধ্যাদেশে ১৯এএএএ ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধারা অনুযায়ী, আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরকারি বন্ড ও ডিভেঞ্চারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে শর্ত হচ্ছে, ৩ বছরের জন্য এই বিনিয়োগ করতে হবে। এর আগে বিনিয়োগের টাকা উত্তোলন করলে করদাতাকে সাধারণ হারে কর পরিশোধ করতে হবে।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে কালো টাকা বিনিয়োগে আসবে না। বরং টাকা পাচার বাড়বে। কালো টাকা বিনিয়োগে আনতে হলে প্রথমত, সব ধরনের শর্ত বাতিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারের কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না-এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে এবং আইন করে কমপক্ষে ৫ বছরের জন্য দায়মুক্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের তথ্য গোপন থাকার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং শিল্প অনুযায়ী অন্যান্য শিল্পের মতো কর অবকাশ সুবিধা দিতে হবে। করোনা মোকাবেলায় কালো টাকা এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগে আনতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে অর্থনীতির ঝুঁকি অনেকাংশে প্রশমন হবে।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বৈধ আয়, সব কাগজপত্র আছে, অথচ আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারেনি-এমন অপ্রদর্শিত অর্থ সরকারের দেয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগে এলে এই মুহূর্তে কোনো সংস্থারই প্রশ্ন করা উচিত হবে না। কারণ, বর্তমান সংকট মোকাবেলায় দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। বিনা শর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ সব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া উচিত।
কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা যুগান্তরকে বলেন, একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে কীভাবে বৈধ টাকা অপ্রদর্শিত অর্থে রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে। যেমন: জমি কেনাবেচার সময় মৌজা রেটে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, বিদ্যমান মৌজা রেটের কয়েকগুণ বেশি দরে জমি কেনাবেচা হয়। সে ক্ষেত্রে মৌজা রেট অনুযায়ী ১ বিঘা জমির বিক্রিমূল্য যদি দলিলে ৪০ লাখ টাকা দেখানো হয় এবং বাস্তবে ওই জমি যদি বিক্রি হয় ২ কোটি টাকা মূল্যে তাহলে অবশিষ্ট ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা কি অবৈধ হয়ে যাবে? কেননা, এটা তো দুর্নীতির টাকা না। জমি বিক্রির বৈধ অর্থ। কিন্তু দলিলমূল্যের কারণে প্রকৃত মূল্য বিক্রেতা তার আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করতে পারছে না। আবার প্রকৃত মূল্য দেখিয়ে কোনো ক্রেতা জমি কিনতেও চান না। কেননা সেখানে তার রেজিস্ট্রি খরচ বেশি পড়ে যাবে। তাই এভাবে জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রেও বহু টাকা অপ্রদর্শিত হয়ে আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে দেশের শিল্প সেক্টরসহ পুরো অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরিস্থিতি যদি আরও খারাপের দিকে যায় এবং নতুন করে লকডাউন কিংবা ছুটি ঘোষণা করা হয়, তাহলে বিপদের আর শেষ থাকবে না। বেকার এবং গরিবের সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকবে। কাজহারা হয়ে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে। এ রকম একটি অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকে সামনে রেখে অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং শিল্পোদ্যোক্তারা মনে করেন, আগামী বাজেট একেবারে নতুন চিন্তাভাবনার ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হলে সংকট আরও বাড়বে। তারা মনে করেন, রাতারাতি এখনই যদি করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে যায়, তাহলেও ভূমিকম্পের মতো এর ‘আপটার শকট’ সামাল দিতে কমপক্ষে ১০ বছর লেগে যাবে। তাই এই সংকট মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে প্রধান প্রতিষেধক হিসেবে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ কাজে লাগাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কোনো শর্ত ছাড়াই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীর সব তথ্য গোপন রাখার নিশ্চয়তা প্রদানসহ পারলে প্রণোদনা দিতে হবে। যারা কালো টাকা বিনিয়োগ করবেন, তাদেরকে নির্ধারিত সময়ের জন্য টেক্স হলিডে দেয়া দরকার।
আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন বলেন, অন্য কোনো সংস্থার প্রশ্নের সুযোগ রাখা হলে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় কখনোই বিনিয়োগে আসবে না। সেটা আবাসন হোক বা উৎপাদনশীল খাত। কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে হলে বিনা শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। যেমন ওয়ান-ইলেভেনের সময় দেয়া হয়েছিল। তখন অনেক টাকা বিনিয়োগে এসেছিল। করোনার পরিপ্রেক্ষিতে এবারও সেই ধরনের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
বিনিয়োগকারীদের অনেকে মনে করেন, এ পর্যন্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তা বেশিরভাগ লোক গ্রহণ করেনি। কেননা, ১০ শতাংশ মানে হল ১০০ কোটিতে ১০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারকে তারা এত টাকা দিতে যাবে কেন। প্রশ্ন হল- যার কাছে এই টাকা আছে তিনি তো এভাবে জরিমানা দিয়ে লুকানো টাকা বের করবেন না। বরং শর্তহীনভাবে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিলে যারা বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেছেন তারাও দেশে টাকা ফেরত নিয়ে আসতে আগ্রহী হবেন। তিনি বলেন, টাকা বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলে সেটা পাচার হবেই। বরং কালো টাকা ইকুইটি হিসেবে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে এলে দেশের উপকার হবে। দেশে নতুন নতুন শিল্প হবে।
বিকেএমইএ-র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, দেশে কালো টাকা বিনা শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া উচিত। এতে অন্তত কর্মসংস্থান হবে। তা না হলে কোনো-না-কোনো পন্থায় টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কালো টাকা বিনা শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে সবাই ঘুষ-দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবে। উত্তর সহজ- ঘুষ-দুর্নীতি কেউ বন্ধ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। বরং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে কালো টাকা বিনিয়োগের বড় প্রয়োজন। তাই প্রয়োজনে দায়মুক্তি দিয়ে বিনিয়োগে আনার সব ব্যবস্থা করা উচিত।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, শুধু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ ছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো-না-কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে।
