বিএনপির বাজেট ভাবনায় ১৩ প্রস্তাব
জীবন-জীবিকা রক্ষায় অগ্রাধিকারের তাগিদ
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে সরকারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিন বছর মেয়াদি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
এ লক্ষ্যে কৃষি ও খাদ্য এবং স্বাস্থ্য খাতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ১৩ দফা প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।
আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে মঙ্গলবার উত্তরার নিজ বাসা থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাজেট ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রস্তাব দেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, করোনা সংক্রমণ রোধ করতে না পারলে কোনোভাবেই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতে এহেন ঝুঁকি থাকলে অর্থনীতির স্বস্তির কোনো অবকাশ নেই। আমরা মনে করি তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোয় মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান সংকোচন রোধে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে। আয় সংকোচন রোধ করতে হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, এ সংকটে মানুষের সর্বজনীন মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি প্রদানে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। পুনরুদ্ধার প্যাকেজ ও মুদ্রানীতি সহজ করাসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ‘সামাজিক নিরাপত্তা জাল’ নামে কিছু কর্মসূচি থাকলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল।
১৩ দফা প্রস্তাবের মধ্যে অগ্রাধিকার হিসেবে রয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমকল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠন ও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার, সর্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন, সরকারি বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রম কল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি ও গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কর্মহীন, কর্মক্ষম, বেকার, দরিদ্র মানুষদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।
গত ৪ এপ্রিল করোনা মহামারী মোকাবেলায় বিএনপির পক্ষ থেকে ৮৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তার যে প্যাকেজ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তাকে বাজেট প্রণয়নে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
স্বাস্থ্য খাতে চরম দুরবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনাকালে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সারা দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়েছে। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল করতে হবে। এমন টেকসই ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি করোনা জাতীয় মহামারীর মতো সংকট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। যারা যুদ্ধকালীন সময়ের মতো সর্বদা প্রস্তুত থাকবে একটি ‘ইন বিল্ড সিস্টেমের’ আওতায়।
স্বাস্থ্য খাতে তথা প্রত্যেকের জন্য পারিবারিক ডাক্তার, নার্স ও অবকাঠামোসহ সামগ্রিক ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য ভাতার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে বিএনপির বাজেট প্রস্তাবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ শ্রেণির মানুষজনের সর্বজনীন সামাজিক কর্মসূচির আওতায় এনে তাদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান, বেকার ভাতা-প্রতিবন্ধী ভাতা-শিশু প্রতিপালন ভাতা-পেনশন ভাতা-আবাসন সুবিধা, স্বাস্থ্য ভাতা প্রদানে এই খাতে জিডিপির ৬-৭ শতাংশ বরাদ্দ, আইটি প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে বিশেষ বরাদ্দ, কৃষি ও খাদ্য খাতে জিডিপি ও বাজেটের কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ ও ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বরাদ্দ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে বরাদ্দ জিডিপির দশমিক ৭৩ শতাংশ ও বাজেটের ২ দশমিক ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি, সবুজ শিল্পায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবন, সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবহেলা উন্নয়নের ইকুইটি ম্যাচিং তহবিল ও কৃষি কমিশন গঠন, প্রবাসীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের সুপারিশও করেছে বিএনপি।
পোশাক শিল্প খাতে মালিক সমিতির শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, মহামারী সংকটকালে শ্রমিকরা যাতে কর্মহীন হয়ে না পড়ে সেজন্য ৫ হাজার কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনা নেয়া মালিকেরা। প্রণোদনাও নেবেন, ছাঁটাইও করবেন- এই দুইটা একসঙ্গে চলতে পারে না। এই সংকট চলাকালে শ্রমিক ছাঁটাই হবে অমানবিক ভুল সিদ্ধান্ত।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর কমবে। ফলে রাজস্ব আশানুরূপ হবে। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর জোর দিতে হবে। বাজেট ঘাটতি ও জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত সহনীয় কোঠায় রাখতে হবে। শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে তারল্য জোগানের মাধ্যমে এই মহামারীর সংকটকাল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। প্রয়োজন সক্রিয় রাজস্বনীতির।
তিনি বলেন, অর্থনীতির অস্বাভাবিক সংকোচনে প্রচলিত বাজেট ব্যবস্থা থেকে সরে এসে তিন বছরের মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করাই ভালো হবে।
আসন্ন বাজেটে জিডিপির ছয় শতাংশ ঘাটতির প্রস্তাব করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এনবিআরের পক্ষে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ (প্রায় ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) একেবারেই অসম্ভব। তাই এবারের বাজেট হতে যাচ্ছে কাল্পনিক কাগুজে বাজেট।
