অস্বাভাবিক উল্লম্ফন বিনিয়োগ পরিকল্পনায়
মনির হোসেন
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে সেটিও অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ কিভাবে এ বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় তার দিকনির্দেশনা নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পরিকল্পনা নজিরবিহীন। এর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের মতে, এমনিতেই করোনার কারণে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান সক্ষমতাই ব্যবহার করতে পারছে না। সেখানে নতুন করে কিভাবে এত বিনিয়োগ হবে!
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, এক বছরে বিনিয়োগ দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো অস্বাভাবিক। এটি অভাবনীয়। মনে হয়, এখানে বড় কোনো ভুল আছে। আর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হলে বুঝতে হবে- চলতি বছরে আমরা বিনিয়োগ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ ৩ মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। এ কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়। সংশোধিত মোট লক্ষ্য ধরা হয় ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ০৮ করা হয়। আর বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ শতাংশ কমিয়ে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ করা হয়।
অথচ আগামী বছরে বিনিয়োগের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ১ এবং বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের এ লক্ষ্যমাত্রাকে অসম্ভব বললেও উদার বিশ্লেষণ হবে। তার মতে, করোনার কারণে আগামীতেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকবে। এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারে না। এমনিতেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। এরপর নতুন বিনিয়োগ হওয়া খুবই কঠিন।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, শুধু সক্ষমতা নয়, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগও কমে আসছে। কারণ আগামীতে বেসরকারি খাত পুঁজির সংকটে থাকবে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের অর্থ জোগান দেয় ব্যাংক ও পুঁজিবাজার। দুটি খাতেরই অবস্থা খারাপ। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা। এরপর বাজেট ঘাটতি মেটাতে এ খাত থেকে বড় অংকের ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের টাকা পাওয়া কঠিন হবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ পরিকল্পনায় আমরা উল্লম্ফন দেখেছি। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার কথা ভাবা উচিত। এমনিতেই ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো অনেক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। এছাড়াও বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ৮৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নেবে। আর সরকার এ পরিমাণ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে অর্থের সমস্যা হবে।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য মৌলিক পূর্বশর্ত ৭টি। এগুলো হচ্ছে- পুঁজির সহজলভ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, পর্যাপ্ত জমি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থিতিশীল কর কাঠামো, দক্ষ শ্রমিক এবং আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সহজ ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব সূচকের কোনোটিতেই বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত। তার মতে, বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে।
এ কারণে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। আর বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এ অবস্থার উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা চালু করে। এ সেবার মূল কথা হল বিনিয়োগকারীরা এক ছাদের নিচে বিনিয়োগের সব ধরনের সুবিধা পাবেন। তবে করোনা এসে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বিনিয়োগের আকাশে কালো মেঘ নেমে আসে।
