Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রহস্যে ঘেরা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার: মাস্ক ও পিপিই নিয়ে কী ঘটেছিল

দাম নির্ধারণ না করেই মৌখিক আদেশে ২০ হাজার পিস এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে জেএমআই * এ মাস্ক কেউ ব্যবহার করেনি * ১৪ কোটি টাকার কাজ পায় জেএমআই ৬ কোটি টাকার করোনাসামগ্রী সরবরাহ

Icon

মিজান মালিক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রহস্যে ঘেরা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার: মাস্ক ও পিপিই নিয়ে কী ঘটেছিল

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। ফাইল ছবি

করোনা প্রতিরোধে সুরক্ষাসামগ্রী পিপিই, এন-৯৫ মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। একটি কোম্পানির মাধ্যমে কত টাকা লোপাট হয়েছে তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। যে প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে মাস্ক জালিয়াতির অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠান কিভাবে কাজ পেল, কিভাবে এ কাজে সম্পৃক্ত হল, আরও কোনো প্রতিষ্ঠান অনিয়মে জড়িত আছে কিনা তারও কিছু দিক উঠে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে।

এতে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে এসব খবর পাওয়া গেছে।

জানা যায়, করোনাসামগ্রী ‘এন-৯৫ মাস্ক’ কেনার আগে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পক্ষ থেকে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এমনকি পণ্যের দামও নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। শুধু সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির মৌখিক আদেশে একদিনে ২০ হাজার ৬১০ পিস এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে জেএমআই নামের প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি পিস মাস্কের মূল্য ২২ টাকা হিসাবে ওই মাস্কের বিল আসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বিল তোলার আগেই এ ২০ হাজার মাস্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠায় বিষয়টি তদন্ত পর্যন্ত গড়ায়। সাধারণ মাস্ককে ‘এন-৯৫ মাস্ক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সরবরাহের অভিযোগে শোকজ করা হয় জেএমআইকে। প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার পিস মাস্ক সরবরাহের মৌখিক আদেশ দেয়া হয়েছিল।

সূত্র জানায়, শোকজের জবাবে প্রতিষ্ঠানটি ভুল স্বীকার করে মাস্কগুলো সরিয়ে নেয়। তবে কিছু মাস্ক যা এন-৯৫ নয়, সাধারণ মাস্ক হিসেবে মুগদা হাসপাতালে রেখে দেয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, বিষয়টি জানাজানির পর কেউ ওই মাস্কগুলো ব্যবহার করেনি। মুগদা হাসপাতালে রেখে দেয়া ৩ হাজার পিস মাস্ক সাধারণ মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলেও জানা যায়। তবে এখনো কোনো মাস্কেরই বিল পরিশোধ করা হয়নি ওই প্রতিষ্ঠানকে।

জানা যায়, করোনা মহামারী দেখা দিলে করোনাসামগ্রী কেনায় ৯০০ কোটি টাকার বরাদ্দ পায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। এর মধ্যে ১৪ কোটি টাকার কাজ পায় জেএমআই গ্রুপ। এর মধ্যে তারা সরবরাহ করে ৬ কোটি টাকার করোনাসামগ্রী। মাস্ক নিয়ে অভিযোগ ওঠায় তাদের ৬ কোটি টাকার বিলও আটকে গেছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, বরাদ্দের ৯০০ কোটি টাকার মধ্যে ৮৮৬ কোটি টাকার কাজ স্বাস্থ্য খাতের গডফাদার মিঠু বাহিনীসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেট ভাগাভাগি করে পায়। যেসব সিন্ডকেটের বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সদ্য বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ। তিনি বলেছেন, মিঠু সিন্ডিকেটকে কাজ দেয়ার জন্য তার ওপর নানাভাবে চাপ দেয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে সরিয়েই দেয়া হয় ওই পদ থেকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহর সঙ্গে ২০ হাজার ৬১০ পিস এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি কোনো সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দিয়েছেন- এমন কান কথারও সত্যতা মেলেনি। বরং ৮৮৬ কোটি টাকার কাজ সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তাকে যে চাপ দেয়া হয় তা ছিল নজিরবিহীন। ওই চাপে নতি স্বীকার না করায় সরে যেতে হয় তাকে।

এদিকে, জেএমআই কিভাবে সিএমএসডির সঙ্গে করোনাসামগ্রী সরবরাহে যুক্ত হল সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে কিছু তথ্য জানা যায়। এতে দেখা যায়, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুজিট ম্যানুফ্যাকচারিং সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক ৩ মার্চ থেকে সিএমএসডির চাহিদামতো সরবরাহ করে আসছে। এর আগে ১৬ ফেব্রয়ারি সরকারের চাহিদামতো ১০ লাখ পিস হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। সেগুলো সরকারের পক্ষ থেকে চীন সরকারকে দেয়া হয় বলে সূত্রটি জানায়।

তার ধারাবাহিকতায় ৩ মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম চালানে ৪০ হাজার পিস হ্যান্ড গ্লাভস, ১১ মার্চ ২০ হাজার পিস হ্যান্ড গ্লাভস ও ২ হাজার পিস মাস্ক, ১৫ মার্চ ২০ হাজার পিস হ্যান্ড গ্লাভস ও ১ হাজার পিস মাস্ক সরবরাহ করে। এ প্রক্রিয়ায় ১৬ মার্চ ও ২৭ মার্চ মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস সরবরাহ করে।

সিএমএসডি জরুরিভিত্তিতে করোনাসামগ্রী দিতে বললে ২০ হাজার ৬১০ পিস এন-৯৫ মাস্ক জেএমআই তড়িঘড়ি করে সরবরাহ করে। এগুলো মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর কার্টন খুলে দেখা যায়, আসল এন-৯৫ মাস্ক নয়। আসল এন-৯৫ মাস্কের ভেতরে আলাদা একটা পাতলা মখমল জাতীয় কাপড়ের প্রলেপ থাকে। ওই মাস্কে তা ছিল না। সে কারণে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি বিষয়টি লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরকেও জানান তারা।

পরে এ বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে গড়ায়। এর একপর্যায়ে মানহীন এন-৯৫ মাস্ক তৈরিতে যুক্ত জেএমআইর কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বিভাগের প্রধান ড. মো. জাকির হোসেনসহ চার কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রাজ্জাক সিএমএসডির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহর কাছে ভুল স্বীকার করেন বলে জানা যায়। তিনি তদন্ত কমিটির কাছে বলেছেন, এটা তার কর্মকর্তাদের গাফলতির কারণে হয়েছে। করোনা শুরু হলে অনেক কর্মচারী চলে যায়। সে জন্য কিছু নতুন লোককে দিয়ে কাজটি করার কারণে এটি হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

এ পর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৯ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির কাছেও ভুল স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। মে মাসের ২০ তারিখের দিকে ওই কমিটি সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে।

কী আছে সেই প্রতিবেদনে : ‘মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে এন-৯৫ ব্র্যান্ডের মোড়কে সাধারণ ও নিুমানের মাস্ক সরবরাহ’ বিষয় প্রতিবেদনে বলা হয়- সিএমএসডির মৌখিক নির্দেশে জেএমআইয়ের কাছে ৫০ হাজার ফেস মাস্ক সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। চাহিদা অনুযায়ী জেএমআই দুটি চালানের মাধ্যমে ২০ হাজার ৬১০টি সাধারণ মানের মাস্ক সরবরাহ করে। হাসপাতালের পরিচালক এ চালান পেয়ে নিশ্চিত হন এগুলো এন-৯৫ মাস্ক নয়। তাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। তখন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের মাস্ক ফেরত নিয়ে যায়। তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটি তাদের মতামত ও সুপারিশ প্রদান করে। মতামতে বলা হয়, সাধারণ মাস্কের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহকারী গবেষণা পর্যায়ের এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে। সিএমএসডির পরিচালক সরবরাহকারীকে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশসহ পণ্য ফেরত নেয়ার নির্দেশ দেন।

কমিটির সুপারিশ : তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করে। এতে বলা হয়- ১. ‘এন-৯৫ মাস্ক নয় মর্মে সন্দেহ হওয়া সত্ত্বেও সিএমএসডির পরিচালককে অবহিত না করে এন-৯৫ মাস্কের মোড়কে ও চালানে সরবরাহকৃত পণ্য গ্রহণ করায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’ ২. ‘পিপিইএর চাহিদা নিরূপণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করা দরকার।’ ৩. ‘এন-৯৫ মাস্ক উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে অধিকতর সচেতন হওয়া দরকার।’

জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, ৯০০ কোটি টাকার কাজের মধ্যে আমাকে মৌখিক অর্ডার দেয়া হয় জরুরিভিত্তিতে এন-৯৫ মাস্ক তৈরি করে দিতে। ৫০ হাজার পিসের মধ্যে প্রথম লটে সরবরাহ করা ২০ হাজার পিস নিুমানের হয়েছে। এটা আমার কতিপয় কর্মকর্তার কারণে হয়েছে। ৪ লাখ টাকার পণ্য সরবরাহ করে আর কত লাভ করব। কিন্তু একটি ভুলে আমার প্রতিষ্ঠানের ২৩ বছরের সুনাম নষ্ট হল। তিনি জানান, করোনা শুরু হলে নমুনা পরীক্ষার কিটের সংকট দেখা দেয়। আমার প্রতিষ্ঠানই ‘সোয়াব’ কিট স্যাম্পল তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুরোধে তাদের সরবরাহ করি। সেই কিটের রেজাল্টও সঠিক আসে। অনেকের করোনা শনাক্ত হয়। তিনি নিজের ভুল স্বীকারের পাশাপাশি বলেন, অনিচ্ছাকৃত এ ভুলের কোনো ফসল আমার ঘরে তুলিনি। আমি ১৪ কোটি টাকার কাজ পাই। এর মধ্যে ৬ কোটি টাকার মালামাল সরবরাহ করি। তবে কোনো বিল পাইনি। ৯০০ কোটি টাকার মধ্যে ৮৮৬ কোটি টাকার কাজ কারা কিভাবে পেয়েছে আমি বলতে পারব না। তিনি জানান, আমরা ৫০ হাজার পিপিইর অর্ডার পেলেও মানসম্পন্ন পিপিই সরবরাহ করতে পারবে না বলে চিঠি দিয়ে সিএমএইচডিকে জানিয়ে দিয়েছি।

এ বিষয়ে কথা বলতে সিএমএসডির বর্তমান পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামানকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে সদ্য বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সিন্ডিকেটের স্বার্থ বাস্তবায়ন না করার কারণে তাকে সরে যেতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার সিএমএসডির পরিচালকের পদ থেকে। এন-৯৫ মাস্কসহ সরঞ্জাম ক্রয়ে সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা না করায় সিএমএসডি থেকে তাকে সরানো হয়েছে। অনেকেই বলেছিলেন, এখানে অনেক সিন্ডিকেট আছে। সেই সিন্ডিকেট এখনও আছে। স্বাস্থ্য খাতের সেই পুরনো নাম উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ বলেন, মিঠু গ্রুপ ও তার বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে নামে-বেনামে। প্রতি বছরই তারা কোম্পানির নামও প্রয়োজনে পরিবর্তন করে। যেমন জহির গ্রুপ আছে। বিভিন্ন গ্রুপ এখনও সক্রিয়।

আমি স্বাভাবিকভাবেই ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের তদবির আমলে নেইনি। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগও করেন তিনি। এদিকে, মাস্ক কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য যুগান্তরকে জানান, এ ঘটনা নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের টিম অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে। তবে ওই কমিটি স্বাস্থ্য খাতের পুরো অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কাজ করবে। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে কারা সিন্ডিকেট করে সরকারের টাকা তসরুপ করেছে। তদন্তে রাঘববোয়ালদের নাম উঠে এলে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে কমিশনের মনোভাব তিনি যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেন।

মাস্ক কেন্দ্রীয় ঔষধাগার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম