বে-টার্মিনাল নির্মাণ
দেশের সক্ষমতা সত্ত্বেও কাজ পাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান
বে-টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুর ও সৌদি এবং পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেশনে সৌদি ও আরব আমিরাতের কোম্পানি এগিয়ে * প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে সারসংক্ষেপ
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে বঙ্গোপসাগরের তীরে বে-টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ও সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে (আরএসজিটি) প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে।
অপরদিকে নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের অপারেটর হিসেবে আরএসজিসি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি টু জি) পলিসি অনুযায়ী নেগোসিয়েশন সফল হলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পৃথক চুক্তি করবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, দেশীয় অর্থে ধাপে ধাপে বে-টার্মিনাল নির্মাণে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
মার্চে দেয়া ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, বে-টার্মিনাল নির্মাণে যে ৯টি দেশ বা প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব করেছে সেগুলোর কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ নয় এবং দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে ওই প্রস্তাব নাকচ করে বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে নৌ মন্ত্রণালয়।
বে-টার্মিনাল ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি অবহিত করে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সার-সংক্ষেপ পাঠিয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে পিএসএ সিঙ্গাপুর, আরএসজিটি ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আলোচনা চলছে। নেগোসিয়েশন হলে চুক্তি করব। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের আগ্রহ ও সক্ষমতা সত্ত্বেও বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর মোটা অংকের টাকা মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষ আগ্রহ দেখানোর আগেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। সব দিক বিবেচনা করেই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে হয়ে থাকে। বন্দরের তিনটি টার্মিনাল যথা- জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পণ্য উঠানামা করে।
এছাড়া তেল খালাসের জন্য ৪টি ডলফিন জেটি রয়েছে। জোয়ারের ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরে দিনে দু’বার সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট জাহাজ ভিড়তে পারে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ১০ কোটি ৩১ লাখ টন কার্গো ও ৩০ লাখ ৯০ হাজার টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। বন্দরে আসার নৌপথের গভীরতা কম হওয়ায় মাদার ভেসেল এ বন্দরে আসতে পারে না।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকাসহ কয়েকটি দেশের বন্দরে পণ্য আনার পর ফিডার ভেসেলে চট্টগ্রাম আসে। এতে যাত্রাপথে ও বন্দরে সময় বেশি লাগে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে ১২ মিটার গভীরতা ও ২৮০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ এ বন্দরে চলে আসতে পারবে। তখন চ্যানেলের প্রশস্ততা হবে ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ মিটার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের সক্ষমতার চেয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বেড়েছে। বন্দরের সক্ষমতার বাইরে বাড়তি শ্রম ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সামনে বাণিজ্য আরও বাড়বে সেজন্য বে-টার্মিনাল দরকার। তবে নিজস্ব অর্থায়নে টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বে-টার্মিনাল নির্মাণে ৯টি দেশ বা প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে চীন ও ভারতও রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জিটুজি পলিসিতে দুই বন্দরে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশে এ তিনটি দেশের সরাসরি বিনিয়োগ নেই।
বন্দরের কার্যক্রমে এসব দেশ সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণ করা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত হলে বে-টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় বেড়ে যাবে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে তা পুষিয়ে যাবে।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে বে-টার্মিনাল নির্মাণে একটি প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ২ দশমিক ১ বিলিয় ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বে-টার্মিনাল নির্মাণে অর্থায়নের জন্য এডিবির সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা।
এডিবি ১-২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আশ্বাস দেয়। কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠান এডিবি থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিলে সুদের হার দাঁড়াবে ৪-৫ শতাংশ।
বে-টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরব : বে-টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন ও সমীক্ষা রিপোর্ট দেখার পর এ পর্যন্ত ৯টি দেশ বা প্রতিষ্ঠান এ টার্মিনাল নির্মাণে প্রস্তাব দিয়েছে।
সেগুলো হচ্ছে- পিএসএ (সিঙ্গাপুর), কোরিয়ার সমুদ্র ও মৎস্য মন্ত্রণালয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, সৌদি আরবের আরএসজিটি, চীনের সিএম পোর্ট হোল্ডিংস, ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস, ভারতের আদানি গ্রুপ ও তৃতীয় এলওসি এবং এডিবি। তবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটি সিঙ্গাপুরের পিএসএকে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করেছে।
এছাড়া সৌদি আরবের আরএসজিটিকেও প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে। তবে সম্ভাব্য ব্যয় কত হবে এবং কিভাবে তা পরিশোধ তবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, সমীক্ষা রিপোর্ট ও কনসেপচুয়াল লে-আউট অনুযায়ী বে-টার্মিনালে তিনটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল হওয়ার কথা রয়েছে।
১ হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ১টি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, ১ হাজার ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার টার্মিনাল-১ ও ৮৩০ মিটার দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার টার্মিনাল-২ এবং ৩ হাজার ৫৫৫ মিটার বিশিষ্ট ১৩টি জেটি নির্মাণ হবে।
এছাড়া সাগরের ঢেউ থেকে টার্মিনাল রক্ষা করার জন্য ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হবে।
দেশীয় অর্থে বে-টার্মিনাল করতে চেয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে ও দেশীয় অর্থে বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক ১০ মার্চ এক চিঠিতে এ সংক্রান্ত সার-সংক্ষেপ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। ওই সার-সংক্ষেপে কোনো প্রক্রিয়ায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে সে সংক্রান্ত বিবরণও তুলে ধরা হয়।
এতে তিনি বলেন, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এতে যেমন সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, তেমনি দেশীয় অর্থ বিদেশ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। দেশীয় অর্থ ব্যবহার করে বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন করলে ধাপে ধাপে প্রকল্পটির সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কিন্তু এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেটর : নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের অপারেটর হিসেবে আরএসজিসি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে। সৌদি আরব ২৭ এপ্রিল এক চিঠিতে বাংলাদেশ নেভি ওয়েলফেয়ার উইংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ফেলিক্সিবল পার্টনারশিপের ভিত্তেতে পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেশনের প্রস্তাব করে।
প্রস্তাবে তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, কনটেইনার স্টোরেজ ও হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং জেটি থেকে স্টোরেজ এলাকা পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়েছে। অপরদিকে ডিপি ওয়ার্ল্ড ২৪ জুন বে-টার্মিনাল ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজে আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি দেয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক তালিকায় রেখেছে।
পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে যৌথভাবে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে বা একটিকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো দেশ এগিয়ে এলেও সেগুলোও বিবেচনায় রাখা হবে বলে জানা গেছে।
