পাওনা বুঝিয়ে পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত
তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের তালিকা তৈরির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর * বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা * অবসরে পাঠানো হচ্ছে ২৫ হাজার শ্রমিককে
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শ্রমিকদের ‘শতভাগ’ পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের পাওনা এককালীন পরিশোধ করতে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। আগামী তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান। তার আগে সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কার্যালয়ের সচিবের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করেন।
আহমদ কায়কাউস সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এখানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করে তাদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে। ২০১৫ সালের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রায় ২৫ হাজার পাটকল শ্রমিককে অবসরকালীন সুবিধাসহ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়া হবে। সেজন্য আগামী তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২৭ জুন যুগান্তরে ‘পাটশিল্পের লোকসান রোধের উদ্যোগ : গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে ২৫ হাজার শ্রমিক’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পরদিনই এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত জানান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ৮ হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন, তাদের সব পাওনাও একসঙ্গে বুঝিয়ে দেয়া হবে। সেখানে উপস্থিত থাকা বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া সেদিন বলেন, শ্রমিকদের অবসায়নের পর আগামী ছয় মাসের মধ্যে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় আধুনিকায়ন করে এসব পাটকলকে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন।
পাওনা পরিশোধ যেভাবে : প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জানান, পাটকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে সরকার কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- দুই লাখ টাকার কম যাদের পাওনা হবে, তাদের পুরো টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেয়া হবে। দুই লাখের বেশি পাওনা হলে ৫০ শতাংশ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেয়া হবে। বাকি ৫০ শতাংশ টাকা দেয়া হবে তিন মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের আকারে। তার মানে হচ্ছে, এই সঞ্চয়পত্র থেকে তিনি ইন্টারেস্ট পাবেন। আমরা একটা হিসাব করে দেখেছি, যদি গড়ে ১১ শতাংশ হারে মুনাফা দেয়া হয়, তাহলে তিন মাসে গড়ে ১৯ হাজার ৩২০ টাকা থেকে ৭৪ হাজার ৫২০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা পেতে পারেন তারা। তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে একজন শ্রমিক যা এখন নগদে পেত তার চেয়ে বেশি পাবে যদি আমি মাসিক মুনাফাটা হিসাব করি। নিম্ন আয়ের শ্রমিক ভাইবোনদের জীবনের নিশ্চয়তার জন্যই প্রধানমন্ত্রী এটি করেছেন।’ তিনি বলেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী, চাকরির অবসায়নের মাধ্যমে পাটকল শ্রমিকরা গড়ে ১৩.৮৬ লাখ টাকা পাবেন। কারও কারও ক্ষেত্রে তা ৫৪ লাখ টাকাও হবে।
‘নিরুপায়’ সিদ্ধান্ত : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার দেশের সব পাটকল জাতীয়করণ করে। ১৯৭২ সালে ৭৮টি পাটকল নিয়ে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) যাত্রা শুরু হয়। পরে ৩৫টি মিল সাবেক মালিকদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। বিজেএমসির হাতে এখন ২৬টি মিল আছে, যার মধ্যে মনোয়ার জুট মিল ছাড়া সবগুলোতেই উৎপাদন চলছে। এসব কারখানায় ২৪ হাজার ৮৬৬ জন স্থায়ী শ্রমিকের বাইরে তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক আছে প্রায় ২৬ হাজার। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ দেখাতে পারলেও বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলো বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘এই ২৬টি মিল ৪৮ বছরের মধ্যে কেবল ৪ বছর কিছুটা লাভ দেখাতে পেরেছিল। বাকি ৪৪ বছরই বিজেএমসি অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা বাড়ছে। আপনারা সবাই জানেন, পাটের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর রয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে উনি পাটের জিনরহস্য উদ্ঘাটনের জন্য গবেষণায় অর্থায়ন করেছিলেন। পাটের যে বহুমুখী ব্যবহার, সেটার ব্যাপারে উনি নজর দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, বিজেএমসি, সেটি প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে পারছে না।’ সচিব বলেন, ‘যেহেতু লোকসান হচ্ছে, সেহেতু বিভিন্ন সময়ে সরকারি অর্থ দিয়ে এগুলো চালাতে হচ্ছিল। তারা (শ্রমিকরা) যথাসময়ে টাকা পাচ্ছিলেন না, বেতনও পাচ্ছিলেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় তিন দিন সময় নিয়েছেন এটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ উনি কোনো মিল বন্ধ করার পক্ষে না।’ গণভবনে সকালের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মুখ্য সচিব বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত আজকে চূড়ান্তভাবে জানানোর জন্য তার কাছ থেকে আমরা সম্মতি পেয়েছি। এই সম্মতি দেয়ার আগেও উনি বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ উনি কাউকে ছাঁটাই করতে চান না।’
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি : এদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো পাটকল শ্রমিকদের কীভাবে পাওনা পরিশোধ করা হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর বিরাজমান পরিস্থিতি স্থায়ী সমাধানসহ পাট খাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো ১ জুলাই থেকে বন্ধ ঘোষণা এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধার আওতায় কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের সমুদয় পাওনা এককালীন পরিশোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদের অর্থাৎ ৬০ দিনের মজুরি, চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি, পিএফ তহবিলে জমাকৃত অর্থ এবং নির্ধারিত হারে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধা পাবেন। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি শ্রমিক সর্বনিম্ন ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন।
কীভাবে এই টাকা পরিশোধ করা হবে তার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শ্রমিকের পাওনার অর্ধেক নগদ এবং বাকি অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে দেয়ার ফলে শ্রমিকরা এক প্রকারের বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের সুযোগ পাবেন, যা তাকে প্রতি তিন মাস অন্তর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুনাফা দেবে।
এতে শ্রমিকদের জন্য একটি বাড়তি আর্থিক সুরক্ষা তৈরি হবে। যারা ১৪ লাখ টাকা পাবেন তাদের ৭ লাখ টাকা নগদ দেয়া হবে। আর বাকি ৭ লাখ টাকার মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র থেকে তিন মাস পরপর ১৯ হাজার ৩২০ টাকা করে পাবেন। যাদের পাওনা ২৪ লাখ টাকা তারা তিন মাস পর পর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৩ হাজার ১২০ টাকা, যাদের পাওনা ৩৮ লাখ টাকা তারা সঞ্চয়পত্র থেকে ৫২ হাজার ৪৪০ টাকা এবং যাদের পাওনা ৫৪ লাখ টাকা তারা তিন মাস অন্তর সঞ্চয়পত্র থেকে ৭৪ হাজার ৫২০ টাকা করে পাবেন।
