ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সাক্ষীদের সুরক্ষা দরকার
সিফাতসহ অন্য সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য র্যাবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী * ‘সাক্ষ্য আইন’ সংশোধন করা হচ্ছে -আইনমন্ত্রী * সাক্ষীর সুরক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন আছে -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ * সিফাত যেন নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে -ড. শাহদীন মালিক
আলমগীর হোসেন
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু বিচারে নিরপেক্ষ তদন্ত ও সাক্ষী সুরক্ষার প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, কোনো কারণে এ মামলার রাজসাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী সিফাত যদি সাক্ষ্য না দিতে পারেন, তাহলে মামলাটা দুর্বল হয়ে যাবে।
তার নির্ভয়ে সাক্ষ্য দেয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। এজন্য সিফাত যেন নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন, এটা নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেন, সাক্ষী ও সুষ্ঠু তদন্তই পারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। তাই সাক্ষী সুরক্ষা নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আইন করা দরকার। সিনহা নিহত হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়। দুটি মামলায়ই এরই মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়েছেন নিহত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহার দুই সহযোগী সিফাত ও শিপ্রা। সোমবার রাতে সাংবাদিকদের কাছে তারা ভালো আছেন বলে জানান।
প্রকৃত ঘটনা জানানোর জন্য কিছু সময়ও চেয়েছেন তারা। মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ার সময় তার গাড়িতে ছিলেন সিফাত। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তিনিই। তাই সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুগান্তরকে বলেন, সিফাতসহ অন্য সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য র্যাবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। র্যাব সেটা গুরুত্বসহকারে দেখছে। তিনি বলেন, র্যাবও আমাদের, পলিশও আমাদের।
উল্লেখ্য, ৩ জুলাই সিনহার সঙ্গে শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও তাসকিন কক্সবাজার যান ভ্রমণবিষয়ক ভিডিওচিত্র ধারণ করতে। ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিষবনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা। এ সময় পুলিশ সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আটক করে কারাগারে পাঠায়। পরে রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে আটক করা হয়।
সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলা হয়েছে টেকনাফ থানায়। এই মামলায় সরকারি কাজে বাধা ও গুলিতে নিহত হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মামলার আসামি করা হয়েছে সিফাতকে। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রামু থানায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে শিপ্রা দেবনাথকে। ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন বাদী হয়ে একই আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, থানার এসআই নন্দলাল রক্ষিতসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
জানা যায়, ২০১১ সালে ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ শিরোনামে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অদ্যাবধি সেটি আলোর মুখ দেখেনি। আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এ ব্যাপারে আলাদা আইন না করে ‘সাক্ষ্য আইন’ (এভিডেন্স অ্যাক্ট) সংশোধন করে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, সে বিষয়ে আরেকটি নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে শুরু হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন আইন প্রণয়ন অথবা বিদ্যমান কোনো আইন সংশোধন অর্থাৎ যেভাবেই হোক না কেন, সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সাক্ষ্য আইন’ (এভিডেন্স অ্যাক্ট) সংশোধন করার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনার কারণে সেটা আপাতত বন্ধ আছে। তিনি বলেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী সিফাত যদি নিরাপত্তাহীন মনে করেন, তাহলে তার নিরাপত্তা সরকার অবশ্যই দেবে।
সাক্ষী সুরক্ষা নিয়ে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এই মামলায় সিফাত হচ্ছেন একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে সুরক্ষা দিতে হবে। কেননা ওই পক্ষ চেষ্টা করবে তাকে সরিয়ে দিতে। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, সিফাতকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ), র্যাব যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সাক্ষীর সুরক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আমেরিকায় এক স্টেটের সাক্ষী অন্য স্টেটে রাখা হয়। এভাবে সাক্ষী সুরক্ষা দিতে পারলে ভালো। তিনি বলেন, সাক্ষী সিফাতের সুরক্ষার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, এই মামলায় একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী হচ্ছেন সিফাত। কোনো কারণে সিফাত যদি সাক্ষ্য দিতে না পারেন, তাহলে মামলাটা দুর্বল হয়ে যাবে। তাই সিফাত যেন নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমি অনুরোধ করব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে, উনি যেন দায়িত্ব নিয়ে তার নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করেন।
সুপ্রিমকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া একটি গণমাধ্যমকে বলেন, সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত। এটা করতে পারলে সারা দেশে বিচার ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
