জানাজায় লাখো মানুষের ঢল
আল্লামা শফীকে চোখের পানিতে চিরবিদায়
হাটহাজারী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ধর্মপ্রাণ লাখো মানুষের চোখের পানিতে চিরবিদায় নিলেন দেশের কওমি অঙ্গনের শীর্ষ আলেম হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী। হাটহাজারী ডাকবাংলো মাঠে শনিবার বেলা ২টা ১৫ মিনিটে তার জানাজা হয়।
পরে প্রিয় কর্মস্থল আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার বাইতুল আতিক জামে মসজিদসংলগ্ন ‘মাকবাতুল জামিয়া’ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ।
আল্লামা শফীর জানাজায় অংশ নিতে শুক্রবার রাত থেকেই হাটহাজারীতে আসতে থাকেন আলেম-ওলামা ও কওমি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। সকাল থেকে তা পরিণত হয় জনস্রোতে।
দুপুরের আগেই মাদ্রাসা ময়দান ছাপিয়ে এর আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল।
ফলে মাদ্রাসা ময়দানের পরিবর্তে জানাজার আয়োজন করা হয় ডাকবাংলো মাঠে। কিন্তু সে মাঠ ছাপিয়ে মাদ্রাসা মাঠ, আশপাশের রাস্তা, অলিগলি ফাঁকা স্থান- যে যেখানে পারেন দাঁড়িয়ে যান জানাজায়।
স্মরণকালের বৃহত্তম এ জানাজায় অংশ নেন হাটহাজারীর সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক এমপি জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বদিউল আলম, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক, র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান প্রমুখ। জানাজার আগে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ দেশবাসীর কাছে তার বাবার জন্য দোয়া চান।
জানাজা উপলক্ষে এলাকাজুড়ে বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর ৬০০ সদস্যের পাশাপাশি ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয় হাটহাজারী, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়িতে।
চার উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন সাত ম্যাজিস্ট্রেট। সকাল ৯টায় তার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি হাটহাজারীতে এসে পৌঁছায়। প্রথমে মাদ্রাসার অদূরে কেন্দ্রীয় ঈদগাহসংলগ্ন তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে ২৫ মিনিট অ্যাম্বুলেন্সটি অবস্থান করে। এ সময় তার আত্মীয়-স্বজনরা তাকে একনজর দেখে নেন। তারপর তাকে নেয়া হয় তার প্রিয় কর্মস্থল হাটহাজারী মাদ্রাসায়।
তার ছাত্র, সহকর্মী, ভক্ত ও অনুসারীরা তাকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ভেঙে পড়েন কান্নায়। এ সময় ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহতও হন।
জোহরের নামাজের আগে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব ও মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক মাওলানা শেখ আহম্মদসহ মাদ্রাসার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
এ সময় আল্লামা বাবুনগরী বলেন, ‘আমার শিক্ষক ও সবার মুরব্বি আল্লামা শফী চলে যাওয়াতে আমাদের কওমি অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে হুজুরের রেখে যাওয়া কর্মসূচিকে সামনে রেখে হেফাজত ও হাটহাজারী মাদ্রাসাকে আমরা সবাই এগিয়ে নিয়ে যাব। এ জন্য আপনাদের সবার সহযোগিতা ও ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
শুধু হাটহাজারী বা চট্টগ্রাম নয়, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা তো বটেই এমনকি ঢাকা-সিলেটসহ দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন জানাজায় অংশ নিতে।
বাস-মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে তারা আসতে থাকেন। সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক বন্ধ করে দেয়।
এ সময় কয়েক কিলোমিটার হেঁটে লোকজনকে জানাজাস্থলে যেতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম নগরী থেকে যাওয়া লোকজনকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বিশ্ববিদ্যালয় দুই নম্বর গেট এলাকায় গাড়ি রেখে হেঁটে যেতে হয়েছে।
সিলেট থেকে আসা মাওলানা মো. আবদুল গফুর নিজেকে সাবেক ছাত্র পরিচয় দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, হুজুরকে শেষবারের মতো দেখতে সিলেট থেকে এসেছি। দেরিতে আসলে দেখতে পাব না।
তাই সকাল সাড়ে ১০টার আগেই মাদ্রাসায় চলে এসেছি। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমাদের কওমি অঙ্গনের অভিভাবক ছিলেন।
তিনিই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও আওলাদে রাসুল মাওলানা সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদনীর কাছে খেলাফতপ্রাপ্ত সর্বশেষ আলেম ছিলেন।
আবু হুরাইরা নামে আরেকজন বলেন, আমি সরাসরি তার ছাত্র ছিলাম না। এখানে হেফজ বিভাগ থেকে পড়েছি। ২০০১ সালে মাদ্রাসা থেকে গিয়ে এখন অন্য একটি মাদ্রাসায় পড়াই। হুজুর মারা গেছেন শুনে সব কিছু বাদ দিয়ে চলে আসছি।
তাকে এক নজর দেখব ভাই। আরেকজন বলেন, আল্লামা আহমদ শফীর বিদায়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনোই পূরণ হবার নয়। উপ-মহাদেশে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো আলেমের উপস্থিতি বিরল।’
কওমি মাদরাসার সম্মিলিত শিক্ষা সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলাইয়া লিল জামিয়াতুল কওমিয়া বাংলাদেশ ও কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রাত ১১টার দিকে সেখান থেকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় লাশ নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে গোসল ও কাফন পড়ানো শেষে ভক্ত অনুসারীদের তার লাশ দেখার সুযোগ দেয়া হয়। মধ্যরাতে তার লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার উদ্দেশে রওনা দেয়।
আল্লামা শফী ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন -আইজিপি : আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
শনিবার এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, আল্লামা শফী একজন সৎ এবং নির্ভীক আলেমে দ্বীন ছিলেন। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তার আপসহীন ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এদিকে পৃথক বার্তায় শোক জানান, ময়মনসিংহ-৭ ত্রিশাল আসনের সংসদ সদস্য ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাফেজ মাওলানা রুহুল আমীন মাদানী।
