বিব্রত নিয়ন্ত্রক সংস্থা
ওয়ালটনের আর্থিক রিপোর্ট পুনঃনিরীক্ষার দাবি
ওয়ালটনের তালিকাভুক্তি বাজারে ভুল বার্তা দিয়েছে -সালমান এফ রহমান
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের কাছ থেকেই ওয়ালটনের আর্থিক প্রতিবেদন পুনঃনিরীক্ষার দাবি উঠেছে। তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে তামাশা সৃষ্টি করছে এই কোম্পানিটি। যেখানে প্রতিবেদন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। অতিরিক্ত প্রিমিয়াম পেতেই এ কাজ করা হয়েছে। কারণ মাত্র ৯ কার্যদিবসেই ৩০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির দাম সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এতে কোম্পানির মালিক পক্ষ ব্যাপক লাভবান হলেও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিতে পড়বেন। কারণ কোম্পানির উদ্যোক্তারা চাইলে ৭০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে পারে। ফলে ভালো একটি অডিট ফার্ম দিয়ে কোম্পানিটির আর্থিক স্থিতিপত্র পুনঃনিরীক্ষা করলে প্রকৃত চেহারা বের হয়ে আসবে। এতে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবে।
পাশাপাশি এটা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জন্য ইতিবাচক হবে। এদিকে ওয়ালটন নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কারণ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে বিএসইসিকে। এমনকি অর্থমন্ত্রীসহ বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সামনে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, ওয়ালটনের তালিকাভুক্তি বাজারে ভুল বার্তা দিয়েছে।
তার মতে, এটি এক ধরনের বিকৃতি। এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক, বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও ওয়ালটনের তালিকাভুক্তি নিয়ে সমালোচনা করছে। যা বিএসইসির জন্য বিব্রতকর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত। এ ব্যাপারে সহজ সমাধানের পথ খুঁজছি।
তিনি বলেন, আমরা বুঝতেছিলাম ওয়ালটন নিয়ে কিছুটা হইচই হবে। তবে এই অবস্থা তৈরি হবে, তা কারও ভাবনায় ছিল না। তিনি বলেন, তিন বছর পর উদ্যোক্তাদের শেয়ারের ওপর থেকে লকইন (বিক্রি নিষেধাজ্ঞা) উঠে যাবে। তখন হয়তো উদ্যোক্তা সুযোগ নিতে চাইবে। তবে এটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
শনিবার রাতে বিএসইসি আয়োজিত ওয়েভিনারে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সালমান এফ রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ালটন বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ শেয়ার ছাড়া হয়েছে। বাকি ৯৯ শতাংশই উদ্যোক্তাদের কাছে। এর ফলে ওয়ালটন বাজারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাজার মূলধনের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি দ্বিধান্বিত (কনফিউজড)। কারণ এটি এক ধরনের বিকৃতি (ডিস্টরশন)।
বাজার মূলধন বাড়ানোর জন্য আপনারা (বিএসইসি) এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছেন কিনা আমি জানি না। তবে এটি বাজারে ভুল বার্তা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি জানতে চাই এর উদ্দেশ্য কী? (আই ওয়ান্ট টু নো, ওয়াট ইজ ইওর অপজেক্টিভ)।
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘বাজারের ব্যাপারে পলিসি অবশ্যই সুসংহত হওয়া উচিত। কারণ অনেক কোম্পানি আমাকে বলেছে, আমরা জানতাম বাজারে তালিকাভুক্তির জন্য ৫০ শতাংশ শেয়ার বিনিয়োগকারীদের দিতে হয়।
এক্ষেত্রে ১ থেকে ২ শতাংশ কিংবা ৫ শতাংশ দিয়েও তালিকাভুক্ত হতে পারলে, তারা বাজারে আসত’। প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা আরও বলেন, কী ধরনের কৌশল বা কী চিন্তা করে ১ শতাংশ শেয়ার দিয়ে তালিকাভুক্ত করা হল তা পরিষ্কার নয়। এটি বাজারে ভুল সংকেত দিয়েছে।
এদিকে দাম আরও বেড়ে ওয়ালটনের ১০ টাকার শেয়ার সোমবার ৯৪০ টাকায় পৌঁছেছে। এতে ৩০২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির দাম সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় পৌছেছে; যা রীতিমতো বাজারে বিস্ময় তৈরি করেছে। আর এ প্রক্রিয়ায় কোম্পানির উদ্যোক্তাদের বাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ার পথ তৈরি হয়েছে। সমস্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
জানতে চাইলে ডিএসইর সদস্য মিনহাজ মান্নান ইমন যুগান্তরকে বলেন, ওয়ালটন নিয়ে আমরা আগে যেসব কথা বলেছি, বর্তমানে সেগুলো প্রতিফলিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাজার নিয়ে তামাশা করছে এই কোম্পানি। কারণ শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি, এই কোম্পানির স্থিতিপত্র প্রশ্নবিদ্ধ। এই রিপোর্ট আগে থেকেই আমরা পুনঃনিরীক্ষার কথা বলেছি।
কিন্তু কমিশন আমলে নেয়নি। এরপর নতুন কমিশন আসার পরও আমরা বলেছি, এই কোম্পানির তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা নয়, কোম্পানির মালিকপক্ষ লাভবান হবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। ইতোমধ্যে কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ার প্রায় হাজার টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্যই দশমিক ৯৭ শতাংশ শেয়ারে বাকি সব শেয়ার উদ্যোক্তাদের হাতে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ওয়ালটনের শেয়ারের ব্যাপারে আমরা কমিশনকে আগেই বলেছিলাম। এটি বাজারে সমস্যা তৈরি করবে। নতুন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও এ ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি। বিষয়টি একটি সমাধান জরুরি। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আর্থিক রিপোর্ট পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে।
তবে কোম্পানির আর্থিক রিপোর্ট পুনঃনিরীক্ষার ব্যাপারে কোম্পানির প্রতিক্রিয়া জানতে ওয়ালটনের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে লিখিতভাবে প্রশ্ন করতে বলেন। এরপর ই-মেইলে লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর পর ২ দিনেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
কোম্পানির পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন এসএম নুরুল আলম রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান এসএম শামসুল আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আশরাফুল আলম, অন্য পরিচালকদের মধ্যে রয়েছে মাহবুবুল আলম, এসএম রেজাউল আলম, এসএম মঞ্জুরুল আলম অভি, তাহমিনা আফরোজ তান্না এবং রাইসা সিগমা হিমা। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর এবং এসএ মল্লিক।
জানা যায়, আইপিওতে ২৫২ টাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই কোম্পানির শেয়ার পেয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর বাজারে এই কোম্পানির প্রথম লেনদেন হয়। এরপর টানা বাড়তে থাকে দাম। আর সোমবার পর্যন্ত ৯ কার্যদিবসে তা ৯৪০ টাকায় উন্নীত হয়। এছাড়াও কোম্পানিতে বর্তমানে ব্যাংক ঋণ ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৯২০ কোটি এবং দীর্ঘমেয়াদি ৬২০ কোটি টাকা। এর মানে হল, ঋণজনিত ঝুঁকিতে এই প্রতিষ্ঠান।
চরম মন্দা বাজারে অতিরিক্ত দামেই রহস্যজনক কারণে অনুমোদন পেয়েছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্রাথমিক শেয়ার (আইপিও)। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে অদৃশ্য কারণে অনুমোদন দেয় বিএসইসি। মার্চের শুরুতে ওয়ালটনের বিডিং শেষ হয়। এরপর তা অনুমোদনের জন্য বিএসইসিতে আবেদন করে কোম্পানিটি।
পরবর্তীকালে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আর্থিক বিবরণী পুনর্মূল্যায়নের দাবি আসে। এরপর আইপিও থেমে যায়। গড়িয়ে যায় অনেক সময়। এরপর নতুন কমিশন এসে আইপিও অনুমোদন দেয়। এক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের একজন কমিশনার আপত্তি (নোট ডিসেন্ট) দিলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
জানা যায়, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে কোম্পানির কাট অব প্রাইস নির্ধারিত হয় ৩১৫ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক রিপোর্টকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায় ওয়ালটন। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বেশি প্রিমিয়াম পেতে এক বছরেই ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আয় বৃদ্ধির অস্বাভাবিক তথ্য তুলে ধরে।
যেখানে আগের বছরের চেয়ে ২০১৮-১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ২৯১ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে কোম্পানিটির মোট ৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। যার বড় অংশ বিক্রি দেখানো হয়েছে একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন প্লাজার কাছে। এসব পণ্য বিক্রির বড় অংশ বাকিতে। এই বাকিতে বিক্রির অর্থই মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে।
আগের বছর যা ছিল ৩৫২ কোটি টাকা। অথচ পণ্য বিক্রি বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মানে হল- পণ্য বিক্রি কম, কিন্তু মুনাফা অনেক বেশি, যা সাংঘর্ষিক ও অস্বাভাবিক। কিন্তু এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তাদের মুনাফা ৫২ শতাংশ এবং টার্নওভার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছিল।
অন্যদিকে কোম্পানির মুনাফা বাড়লেও একই বছরে কোম্পানির ক্যাশফ্লো ১০২ কোটি টাকা কমেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা কোম্পানির অডিট রিপোর্ট পুনঃনিরীক্ষার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তা আমলে নেয়নি বিএসইসি।
আইপিও অনুমোদনের ফলে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে ২৯ লাখ ২৮ হাজার ৩৪৩টি সাধারণ শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে ইস্যু করছে ওয়ালটন।
পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য ৭ জানুয়ারি বিএসইসি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে বিডিংয়ে অংশ নেয়ার অনুমোদন দেয়। এ অনুমোদনের ফলে কাট-অব প্রাইস নির্ধারণে ২ মার্চ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত যোগ্য বিনিয়োগকারীরা বিডিংয়ে অংশ নেন।
