বিজয় দিবস প্রসঙ্গে কিছু কথা
আজ আমাদের ৪৯তম বিজয় দিবস। আগামী বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করব। একটি জাতির জীবনে ৫০ বছর খুব বেশি বয়স নয়। কিন্তু এই অর্ধশতাব্দীকালে আমাদের জীবনে যা ঘটেছে, যে উত্থান-পতন ঘটেছে, তা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
মাত্র সাড়ে তিন বছর পর আমাদের স্বাধীনতা অপহৃত না হলেও তার আদর্শ, মূল্যবোধগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। জাতির প্রকৃত নায়কের বদলে একজন খলনায়ককে সেখানে স্থাপনের চক্রান্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর জাতি তার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উদ্ধার করেছে; কিন্তু গণতন্ত্র এখনও দেশটিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে অতীতমুখী ধর্মান্ধতা। এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে জয়ী হওয়া না গেলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। এই বিজয় দিবস পালন, এই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান একেবারে আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাবে, তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে পারেনি।
হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলো বাস্তবায়নে কষ্ট হচ্ছে। একদিকে করোনার অভিশাপ, অন্যদিকে ধর্মান্ধতার উত্থান হাসিনা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা জাতির জন্য আরেকটি অশনিসংকেত।
এই মহাদুর্যোগ থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ভাষা আন্দোলনের মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপস গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে না।
যেসব দেশে গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করেছে, সেসব দেশেই গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সংগ্রাম যে সফল হয়েছে, তার কারণ তিনি আপসের পথ পরিহার করে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আজ তার আদর্শ রক্ষা করতে হলে আপসের পথ ত্যাগ করে যুদ্ধের পথ ধরতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমরা রণক্ষেত্রে জয়ী হয়েছি; কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করতে পারিনি।
তারা এখন ধর্মের আবরণে আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের উৎখাত করতে হলে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন তৃণমূল থেকে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই বিপথগামী।
তাদেরকে কী করে আবার আদর্শবাদিতার পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়, আগের মতো সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সে কথা আজ আমাদের সচেতন রাজনৈতিক নেতাদের ভেবে দেখা উচিত।
সময় চলে যাচ্ছে; কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কী চেহারা ধারণ করবে কেউ জানে না। এই বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি দরকার।
এই প্রস্তুতি হচ্ছে- দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের যে প্রবণতা, তা দূর করা এবং বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আবার পুনঃপ্রবর্তন করা। রাষ্ট্রের আদর্শের ভিত্তিটা যদি ভেঙে যায়, তাহলে সে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কীভাবে রক্ষা করা যাবে?
আজকের এই বিজয় দিবসের শপথ হোক- আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করব এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে যাতে দেশটি গড়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখব।
লন্ডন, ১৫.১২.২০
বিজয় দিবস প্রসঙ্গে কিছু কথা
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজ আমাদের ৪৯তম বিজয় দিবস। আগামী বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করব। একটি জাতির জীবনে ৫০ বছর খুব বেশি বয়স নয়। কিন্তু এই অর্ধশতাব্দীকালে আমাদের জীবনে যা ঘটেছে, যে উত্থান-পতন ঘটেছে, তা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
মাত্র সাড়ে তিন বছর পর আমাদের স্বাধীনতা অপহৃত না হলেও তার আদর্শ, মূল্যবোধগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। জাতির প্রকৃত নায়কের বদলে একজন খলনায়ককে সেখানে স্থাপনের চক্রান্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর জাতি তার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উদ্ধার করেছে; কিন্তু গণতন্ত্র এখনও দেশটিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে অতীতমুখী ধর্মান্ধতা। এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে জয়ী হওয়া না গেলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। এই বিজয় দিবস পালন, এই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান একেবারে আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাবে, তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে পারেনি।
হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলো বাস্তবায়নে কষ্ট হচ্ছে। একদিকে করোনার অভিশাপ, অন্যদিকে ধর্মান্ধতার উত্থান হাসিনা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা জাতির জন্য আরেকটি অশনিসংকেত।
এই মহাদুর্যোগ থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ভাষা আন্দোলনের মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপস গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে না।
যেসব দেশে গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করেছে, সেসব দেশেই গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সংগ্রাম যে সফল হয়েছে, তার কারণ তিনি আপসের পথ পরিহার করে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আজ তার আদর্শ রক্ষা করতে হলে আপসের পথ ত্যাগ করে যুদ্ধের পথ ধরতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমরা রণক্ষেত্রে জয়ী হয়েছি; কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করতে পারিনি।
তারা এখন ধর্মের আবরণে আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের উৎখাত করতে হলে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন তৃণমূল থেকে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই বিপথগামী।
তাদেরকে কী করে আবার আদর্শবাদিতার পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়, আগের মতো সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সে কথা আজ আমাদের সচেতন রাজনৈতিক নেতাদের ভেবে দেখা উচিত।
সময় চলে যাচ্ছে; কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কী চেহারা ধারণ করবে কেউ জানে না। এই বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি দরকার।
এই প্রস্তুতি হচ্ছে- দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের যে প্রবণতা, তা দূর করা এবং বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আবার পুনঃপ্রবর্তন করা। রাষ্ট্রের আদর্শের ভিত্তিটা যদি ভেঙে যায়, তাহলে সে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কীভাবে রক্ষা করা যাবে?
আজকের এই বিজয় দিবসের শপথ হোক- আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করব এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে যাতে দেশটি গড়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখব।
লন্ডন, ১৫.১২.২০
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023