বিশ্বব্যাংক-ইফাদের ঋণে এনএটিপি-২ প্রকল্প
‘গুরুত্বহীন’ ব্যয়ের শঙ্কায় সাশ্রয়ী ১৩৫ কোটি টাকা
পিইসি সভায় উঠছে আজ * অহেতুক দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর পাঁয়তারা
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেইজ-টু (এনএটিপি-২) প্রকল্পে সাশ্রয় হওয়া ১৩৫ কোটি টাকা ‘গুরুত্বহীন’ ব্যয়ের প্রস্তাব করেছে কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ১১৮ কোটি টাকাই বৈদেশিক ঋণ। বাকি ১৭ কোটি টাকা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিলের। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা গেছে, প্রয়োজন না থাকলেও উল্লিখিত প্রকল্পে মেয়াদ অহেতুক দুই বছর বাড়ানোর পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। সেখানেই এসব বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামসুল আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় পরিহার করা উচিত। এছাড়া প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে এবং এই সময়ে পরামর্শকসহ কর্মরতদের ভাতা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা কেন মাথায় এলো সেটিই বুঝতে পারছি না। তবে বৈদেশিক ঋণের অর্থ বেঁচে গিয়ে থাকলে সেই টাকা কৃষকদের সমস্যা সমাধানে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা কাজে ব্যয় করা উচিত। যার মাধ্যমে অনেক বেশি উপকার পাওয়া যাবে।
প্রকল্প পরিচালক মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ২০১৪ সালে যখন প্রকল্পটি তৈরি হয়। এরপর ২০১৫ সালে একটি পে-স্কেল হয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়নি।
তখনকার বাজার দর আর এখনকার বাজারদর কি এক? তাই এখন সেটি বাড়ানো হচ্ছে। পরামর্শকদের বেতন বা সুবিধা সমজাতীয় অন্য প্রকল্পের তুলনায় এ প্রকল্পে কম। ফলে ইতোমধ্যেই ৭ জন পরামর্শক চলে গেছেন। কম টাকায় ভালো পরামর্শক পাওয়া যায় না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নানা কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু করতেই ২ বছর দেরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ৭২৪ কোটি টাকার মতো ব্যয় করা যায়নি। ফলে ২ বছর মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আমরা সবাই একমত হয়েছি। এখন পরিকল্পনা কমিশন ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। ফলে তারা এসব কথা বলেছে। যা উত্তর দেয়ার আমরা পিইসি সভায়ই দেব।
বুধবার অনুষ্ঠেয় পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি সংশোধনের অন্যতম কারণ হলো ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বিভিন্ন অঙ্গ হতে অর্থ সাশ্রয় করে কোভিড-১৯ এর কারনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিভিন্ন সহায়তা দেয়া।
কিন্তু আরএডিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায় বিভিন্ন খাত হতে সাশ্রয় করা ১৩৫ কোটি টাকা (এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৭ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণের ১১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা) মাঠ দিবস, প্রদর্শনী, র্যালি, কৃষি উদ্ভাবন ফান্ড এবং এনএপিটি-১ এ সৃষ্ট ফিয়াকগুলোকে (কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র) কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদান কাজে ব্যয় করা হবে।
এছাড়া পরামর্শকের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি, অন্যান্য জনবলের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রমে সমন্বয় করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে কৃষকদের কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে এবং এ ক্ষতি হ্রাস বা পুষিয়ে নেয়ার জন্য কি ধরনের সাহায্য প্রয়োজন সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ উপকারভোগী কৃষকের কোনো মতামত নেয়া হয়নি।
উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো কৃষকদের ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর কিনা তা বোধগম্য নয়। এছাড়া এ ধরনের কার্যক্রমগুলো কৃষি খাতে চলমান শতাধিক প্রকল্পের প্রতিটিতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি কম্পোনেন্টের অধিকাংশ কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে একটির ১৪৩ শতাংশ, ৯টির শতভাগ, ৬টির ৮৫-৯০ ভাগ এবং দুটি কম্পোনেন্টের ৭০-৮০ ভাগ কাজ হয়েছে। মূলত পিএইপডি, পিবিআরজি সাব প্রজেক্ট, এআইএফ-২ ও ৩, মেশিনারি উপকরণ প্রদান, বিল ব্যবস্থাপনা, মাছের পিউর লাই ব্রুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি কাজগুলো চলমান।
প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম বিবেচনায় এটির মেয়াদ ৯ মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করাটাই যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়। প্রকল্পটির বিভিন্ন কার্যক্রম হতে সাশ্রয়কৃত যে অর্থ দিয়ে নতুন ও বর্ধিত কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে তা মূলত ঋণ সহায়তারই একটা বড় অংশ। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রশাসনিক ব্যয়সহ পরামর্শক এবং অন্যান্য পরিচালন ক্ষেত্রে যে ব্যয় বাড়বে তার সিংহভাগই বিশ্বব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিউনিটি এক্সটেনশন এজেন্ট ফর লাইভস্টক, লোকাল এক্সটেনশন এজেন্ট ফর ফিশারিজদের টিএ/ডিএর হার বৃদ্ধি, পণ্য সংগ্রহ ও বিপণন কেন্দ্রে কর্মরতদের লোকাল বিজনেস ফ্যাসিলিটেটরদের বেতন বৃদ্ধি এবং জাতীয় কোর পরামর্শকের পারিশ্রমিক প্যাকেজের সমন্বয়ের মাধ্যমে পারিশ্রমিক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী থেকে পাওয়া অর্থ কোনো অনুদান নয়, ঋণের অর্থ।
তাই এসব খাতের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনুৎপাদনশীল এসব খাতেও ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবটিও যৌক্তিক করা প্রয়োজন। আরও বলা হয়েছে, ডিপিপির পাঁচটি অঙ্গে ট্রাভেল অ্যান্ড ডিএ খাতে মোট বরাদ্দ ১০১ কোটি ৯২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৩০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
এছাড়া প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং পরামর্শকদের জন্য প্রকল্প পরিদর্শনে যাতায়াত ভাতা বাদে প্রতিদিনের ডিএ (ডেইলি অ্যালাউন্স) ৪ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। টিএ-ডিএ বিষয়ে অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী এ হার নির্ধারণ হওয়া আবশ্যক। সরকারি অর্থে নির্ধারিত হারের অতিরিক্ত ব্যয়ের সুযোগ নেই।
এছাড়া বৈদেশিক সহায়তার অর্থ যেহেতু ঋণের অর্থ কাজেই এটিও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পে পাঁচটি অঙ্গে ওভারটাইম বাবদ বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ কোটি ৪১ লাখ ১৬ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধন প্রস্তাবে গাড়িচালকদের ওভারটাইম নির্ধারণ করা হয়েছে মাসিক সর্বোচ্চ ২৫০ ঘণ্টা।
এক্ষেত্রে প্রতিদিন গড়ে ৮ দশমিক ৩৩ ঘণ্টা হবে, যা মোটেও যৌক্তিক নয়। প্রকল্পে ক্রয় করা যানবাহন বিদ্যমান সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সরকারি পরিবহন পুলে জমা দিতে হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্প শেষ হওয়ার পর যানবাহন সংস্থা ব্যবহার করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি বিধির বাইরে এ ধরনের সুযোগ রাখার সুযোগ নেই।
কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের অন্যতম কার্যক্রম হলো- কৃষি উদ্ভাবন ফান্ড-২ এবং কৃষি উদ্ভাবন ফান্ড-৩ এর বাস্তবায়ন। প্রকল্পের প্রায় ৪ বছর ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও এ কার্যক্রমের অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। কারণ কৃষক গ্রুপের নিজস্ব বিনিয়োগের সংস্থান না থাকা। (অর্থাৎ এ ফান্ড পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট অংশ কৃষক গ্রুপকে দিতে হয়)।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আগামী ১-২ বছরে কৃষকদের আর্থিক সংকট কাটবে এরূপ কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই এ ফান্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে ফান্ডের অব্যবহৃত প্রায় ৫১ শতাংশ কার্যক্রম বাস্তবায়নই যৌক্তিক হবে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
সূত্র জানায়, ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেইজ-টু (এনএটিপি-২) প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল হতে ২৭১ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান মিলে ১ হাজার ৬০৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা। কিন্তু এখন ১৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কমিয়ে মোট ১ হাজার ৮৬২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ধরে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের অঙ্ক ঠিক থাকলেও বৈদেশিক অংশে ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৯১ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে রয়েছে- বিশ্বব্যাংকের ঋণ ১ হাজার ৩৬৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ইফাদের ঋণ ১৮৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং ইউএসএআইডির অনুদান রয়েছে ৪১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে আপাত দৃষ্টিতে প্রকল্পে ব্যয় কমলেও ভেতরে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এছাড়া প্রকল্পটি ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। ১ বছর ৯ মাস বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
