Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাক্ষাৎকার: ড. জাহিদ হোসেন

স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব থাকতে হবে

করোনা মহামারির মতো বিশেষ এক পরিস্থিতিতে এবারও তৈরি হচ্ছে জাতীয় বাজেট। এমন প্রেক্ষাপটে গতানুগতিক বাজেট হলেই হবে, নাকি নতুন কিছু থাকতে হবে-এ নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। আর নতুন কিছু করতে হলে কী ধরনের উদ্যোগ থাকতে হবে। কেননা একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা। এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় হলেই তো বাজেট হয়ে উঠবে অনন্য। এমনই মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন-

Icon

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব থাকতে হবে

ড. জাহিদ হোসেন

যুগান্তর : করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

ড. জাহিদ হোসেন : গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজেটে একেবারেই নতুন কিছু উদ্যোগ থাকা জরুরি, যেসব উদ্যোগ বর্তমান বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

যুগান্তর : বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন।

ড. জাহিদ : সাধারণত প্রতি বছরের বাজেটেই বেশকিছু ব্যয় থাকে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে উন্নয়ন ব্যয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার খরচ ইত্যাদি ব্যয় প্রতি বছরই থাকে। কিন্তু এবারের বাজেট হচ্ছে ভিন্ন পরিস্থিতিতে।

অর্থাৎ কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া এ বাজেটে নতুন চিন্তার প্রতিফলন থাকতে হবে। করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে গতানুগতিক বাজেট দিয়ে হবে না, নতুন কিছু উদ্যোগ থাকতে হবে।

যুগান্তর : আগামী বাজেটের চ্যালেঞ্জ কী?

ড. জাহিদ : সামনে অর্থনীতির অনেক চ্যালেঞ্জ আসছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো করোনা মহামারি। তাই বাজেটে অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে হবে সবার আগে। এটি মোকাবিলায় ধারাবাহিকতার বাইরে এসে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে সেটিই হচ্ছে বড় প্রশ্ন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় কী থাকবে। কেননা করোনা দ্রুতই যাবে না। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে চলমান যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কী অবস্থা সেটির পর্যালোচনা থাকতে হবে। গত ১২ মাসে স্বাস্থ্য খাতে যা বরাদ্দ ছিল বা যেসব কর্মসূচি ছিল সেগুলো কার্যকর হয়নি। এজন্য স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।

যেমন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম কোনো একটি নিয়োগে দুুর্নীতির অভিযোগ আছে; ফলে সেটির তদন্ত চলছে। এ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, করোনা মহারির মতো চরম দুর্যোগময় মুহূর্তে সামান্য একটি তদন্তের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে কেন?

এ ছাড়া দেখা গেছে, হাসপাতালের জন্য আমদানি করা যন্ত্রপাতি এয়ারপোর্টেই পড়ে ছিল দীর্ঘদিন, খালাস না করায় অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। এমনটি হওয়া ঠিক নয়। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি এ খাতসংশ্লিষ্ট কর্মসূচিগুলোতে গতি আনার উদ্যোগ থাকতে হবে।

যুগান্তর : ‘লকডাউন’ অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

ড. জাহিদ : করোনা মোকাবিলায় লকডাউন কোনো অস্ত্র নয়। দুর্যোগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেলে তখন চরম পদক্ষেপ হিসাবে সাময়িক লকডাউন দেওয়া যেতে পারে। এর কারণে অনেক ক্ষতি রয়েছে; তাই লকডাউনের বাইরে চিন্তা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন আনতে হবে।

এ ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। সেটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপগুলোও তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে ভ্যাকসিন সংগ্রহ এবং অন্যটি হচ্ছে মানুষের বাহু পর্যন্ত তা পৌঁছে দেওয়া। কাজেই এখানে উদ্যোগ থাকতেই হবে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ভ্যাকসিন এ দেশে উৎপাদন কিংবা আশপাশের কয়েকটি দেশ নিয়ে ভ্যাকসিনের স্টোরেজ গড়ে তোলার যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো স্পষ্ট নয়।

আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল একটি উৎস থেকে ভ্যাকসিন নেওয়ার উদ্যোগ। বিকল্প কোনো ব্যাকাপ ছিল না। এটি যে কত বড় ভুল সেটি এখন প্রমাণিত। আগামী অর্থবছরে এ ভ্যাকসিন কোথা থেকে কত পরিমাণে আসবে, কীভাবে সরবরাহ করা হবে অর্থাৎ ভ্যাকসিন প্রোগ্রাম কী হবে, সেসব স্পষ্ট করে বলতে হবে।

একটি বিষয় হলো, ভ্যাকসিন কিনতে টাকা কোনো সমস্যা নয়। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা ভ্যাকসিন কেনার জন্য টাকা দিচ্ছে। ফলে টাকার কোনো সমস্যা হবে না।

যুগান্তর : স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আরও কিছু বলবেন?

ড. জাহিদ : করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধে অন্যান্য অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে বাজেটে উদ্যোগ থাকা জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পলিসি থাকতে হবে। কোভিড ছাড়াও অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্যও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই।

এক্ষেত্রে যে কাজটি করা যেতে পারে সেটি হচ্ছে, শিল্প-কারখানা চালু রাখার ক্ষেত্রে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে না তাদের জন্য বাজেটে প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। অথবা সোর্স ট্যাক্স বাড়াতে হবে। এরকম বাজেট সম্পর্কিত যেসব ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেগুলো নিতে হবে।

যুগান্তর : অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে বলুন।

ড. জাহিদ : অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ত্রাণ সহায়তা কর্মসূচি পর্যাপ্ত থাকতে হবে। নগর দরিদ্র, নতুন ও পুরোনো দরিদ্র- সবার জন্যই বরাদ্দ রাখতে হবে। শুধু ৩৫ লাখ পরিবারকে সহায়তা দিলে হবে না, কারণ দেশে মোট দরিদ্র ৪-৫ কোটি। তাদের নগদ সহায়তার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান সংকটে আছে, তাদের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ থাকতে হবে।

এক্ষেত্রে গুরুত্ব নির্ধারণ করাটা জরুরি। অর্থাৎ সামাজিক গুরুত্ব যেমন বিবেচনা করতে হবে, তেমনি কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য কর্মসূচি থাকতে হবে। কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং এসএমই খাতে বাজেটে কর সুবিধা, ভর্তুকি, প্রণোদনা বা অনুদান সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রণোদনার ক্ষেত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতা ভালো নয়।

কেননা ব্যাংকিং সিস্টেমে প্রণোদনার অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল; কিন্তু সেই অর্থ ক্ষুদ্রদের কাছে পৌঁছেনি। এজন্য আগামী অর্থবছরে আর্থিক সুবিধা যাই দেওয়া হোক, সেটি যে মাধ্যমে দিলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছাবে সেই মাধ্যমেই দিতে হবে। বড় শিল্পের জন্য কর্মসংস্থানভিত্তিক সহায়তা দিতে হবে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

যেসব শিল্প-কারখানা বেতন দিতে পারবে না, সেগুলোতে শ্রমিকদের সরাসরি বেতনের একটি অংশ সরকার পৌঁছে দিতে পারে। অর্থাৎ শ্রমিকদের পে-রোল প্রটেকশন ব্যবস্থা থাকতে হবে বাজেটে। এক্ষেত্রে যদি কারখানা মালিকদের হাতে টাকা দেওয়া হয়, তাহলে সেটি শ্রমিকদের হাত পর্যন্ত যেতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে; তাই সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টেই কর্মসূচির টাকা দিতে হবে। অর্থনীতি খাদের মধ্যে আছে; সেটি পুনরুদ্ধার করতে হলে কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে।

যুগান্তর : জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

ড. জাহিদ : গত বছরের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কেবল খাদ থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ পুনরুদ্ধার হচ্ছিল। এর মধ্যে বর্তমান কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসায় আবারও অর্থনীতি পিছলে পড়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এডিপির মাধ্যমে সরকারি ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম হয়েছে। সেখানে কোনো প্রবৃদ্ধি নেই।

রপ্তানি ১ শতাংশেরও কম অর্থাৎ ফ্ল্যাট অবস্থায় রয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি নেতিবাচক, ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশ্নই ওঠে না। এ ক্ষেত্রে ১-২ অথবা ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সেটি ভালো হবে। তাই এ বাস্তবতাকে সামনে রখে আগামী অর্থবছরর জন্য ৪-৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করাই উচিত।

যুগান্তর : বৈশ্বিক অবস্থা এবং দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে বলুন।

ড. জাহিদ : চীন বড় অর্থনীতির দেশ। এর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রথম প্রান্তিকে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমেরিকার অর্থনীতিও পুনরুদ্ধার হচ্ছে। যেভাবে ভ্যাকসিনেশন হচ্ছে, এতে মনে হয় আগামী বছরগুলোতে আমেরিকার অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দ্রুতই হবে। এদিকে ইউরোপ ভালো করছে। তবে ব্রিটেনের অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেখানে তো শুধু করোনাভাইরাস নয়, আছে পোস্ট ব্রেক্সিট পর্যায়।

ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় অনেক বিষয় উৎরাতে হবে। তবে ব্রিটেনের বাইরে জার্মানি, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশেও আমাদের বাজার আছে। সেগুলো ভালো হচ্ছে। তাই বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমরা আশাবাদী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বৈদেশিক বাজারগুলোতে চাহিদা ফিরে এলে সেই চাহিদা ধরার মতো অবস্থা বাংলাদেশের থাকবে কিনা? করোনা সংক্রমণ যদি ভারতের মতো হয়, তাহলে বায়াররা আসবে না। তারা বলবে, তোমরা ডেলিভারি দিতে পারবে না। আস্থার জায়গা হারিয়ে যেতে পারে।

তারা ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশে চলে যেতে পারে। এজন্যই ভ্যাকসিন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভ্যাকসিন তো শুধু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় নয়, এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার একটি অন্যতম বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. জাহিদ : ধন্যবাদ।

স্বাস্থ্য খাত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বিশেষ গুরুত্ব থাকতে হবে

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম