অধঃক্রমে এক ধাপ এগিয়ে ১৩তম বাংলাদেশ
দুর্নীতির নেপথ্যে রাজনীতি
টিআই-এর প্রতিবেদন: দুর্নীতির দুষ্টচক্র দেশকে গ্রাস করে ফেলছে * দুর্নীতির কারণে জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ ক্ষতি * প্রতিবছর দেশ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকে বিশ্বে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২১ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। যা আগের বছর ছিল ১২তম। তবে সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ পিছিয়েছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ থেকে বেড়ে ১৪৭তম। অন্যদিকে দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে এবারসহ টানা ৪ বছর বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি। রাজনীতির কারণেই মূলত দেশে দুর্নীতির বিকাশ ঘটছে। আর ক্রমাগত দেশকে গ্রাস করছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র।
জার্মানভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই) ২০২১ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও মঙ্গলবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এবারের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ছিল দুর্নীতি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। প্রতিবেদন অনুসারে এবার কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক এবং সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ সুদান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারি সেবা পেতে ৮৯ শতাংশ মানুষ ঘুস দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিচারহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক দেখাতে পারলেই অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। দুর্নীতি কারণে প্রতিবছর দেশের জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৩ শতাংশ ক্ষতি হয়। আর বিভিন্ন মাধ্যমে ১২ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়।
দুর্নীতি প্রতিরোধে নয় দফা সুপারিশ করেছে টিআই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি, দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬ স্কোর। গত এক দশকের স্কোরের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থান এ স্কোরের কাছাকাছি। এটি হতাশাব্যঞ্জক। এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী ২০২০-এর তুলনায় ১ ধাপ উন্নতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। একই অবস্থানে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। আর সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী একধাপ পিছিয়ে ১৪৭তম। ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে অষ্টমবারের মতো এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পরে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে তৃতীয়। যা বিব্রতকর, উদ্বেজনক ও হতাশার। ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত। তবে তা বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর চেয়ে অনেক কম। এটি অত্যন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘শূন্য সহনশীলতা’র অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হলে সূচকে বাংলাদেশের আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। তিনি বলেন, দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকরতা ও বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত করা করা জরুরি। তারমতে, সরকারি ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্তিগত উন্নয়নের লাইসেন্স হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। করোনা সংকটে স্বাস্থ্য খাতের প্রকট দুর্নীতি-বিশেষ করে, উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির বিচার না হওয়া, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। এসব আমাদের অবস্থানের উন্নতির অন্তরায়।
বিভিন্ন নীতি ও তার প্রয়োগ ক্রমাগত জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাবানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কাজে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা এবং রাঘববোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থতা রয়েছে। গণমাধ্যমে যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করছেন, তাদের হামলা-মামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮৯ শতাংশ মানুষ সরকারি সেবা নিতে ঘুস দিতে বাধ্য হন। ঘুস ছাড়া সরকারি সেবা অসম্ভব। দুর্নীতি আমাদের সাধারণ জীবনাচারের অংশ হয়ে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশে আইন আছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু যাদের ওপর এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ভার, তাদের একাংশই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এরা দুর্নীতির ফলে লাভবান, দুর্নীতিকে সুরক্ষা ও প্রসারে কাজ করেন। অবস্থার উত্তরণে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৮৮ স্কোর পেয়ে ২০২১ সালে কম দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় প্রথম অবস্থানে যৌথভাবে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও নরওয়ে এবং তৃতীয় সুইজারল্যান্ড। আর ১১ স্কোর পেয়ে সর্বনিম্ন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ দক্ষিণ সুদান। দ্বিতীয় সিরিয়া ও সোমালিয়া এবং তৃতীয় ভেনিজুয়েলা। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এবারের সিপিআই অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশেষ করে, গত এক দশকে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের ঘাটতিতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সারা বিশ্বেই এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। ১৮০টি দেশের মধ্যে ১০০টির গড় স্কোর ৪৩-এর কম। ১৩০টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে। গত বছরের তুলনায় স্কোর বেড়েছে ৬৫টি দেশের, কমেছে ৬৬টির এবং ৪৮টি দেশের স্কোর অপরিবর্তিত। এরমধ্যে ২৭টি দেশ তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর করেছে। আর গত ১০ বছরে সার্বিকভাবে ৮৩টি দেশের স্কোর কমেছে। বেড়েছে ৮৪ এবং অপরিবর্তিত ৭টি দেশের স্কোর। রিপোর্টে বলা হয়, যে সব দেশে নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তারাই কম স্কোর পেয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বিশ্বের যে ২৩টি দেশের স্কোর কমেছে, তার ১৯টি নাগরিক স্বাধীনতা সূচকেও কম স্কোর পেয়েছে। বিশেষ করে, ২০২০ সালে বিশ্বে ৩৩১ জন মানবাধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এর ৯৮ শতাংশই এমন সব দেশে ঘটেছে, যাদের স্কোর ৪৫-এর নিচে। এবার এশিয়ার মধ্যে কম দুর্নীতি ভুটানে। সূচকে দেশটির স্কোর ৬৮। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশই গত বছরের চেয়ে স্কোর বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। ভুটান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানের কমেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গতবারের মতোই ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো-বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট ডেটাসেটের রিপোর্ট।
জরিপগুলোতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের ধারণার প্রতিফলন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসাবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয় যে, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবির কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্যও এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই টিআইবি ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন-টিআইবির নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
