শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন শিক্ষাবিদদের অভিমত
কর্তৃপক্ষ চাইলে একদিনেই বন্ধ করা সম্ভব
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে-ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ এক রকম নির্বিকার। তারা চাইলে একদিনেই এসব অপকর্ম বন্ধ করা সম্ভব-এমন মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা।
তাদের মতে, এসব অপকর্মে ছাত্রলীগের গুটিকয়েক কর্মী জড়িত। তাদের এই অপকর্ম সরকার বা আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে বাড়তি কিছু দিচ্ছে না। বরং দলের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করছে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে শুক্রবার এসব মন্তব্য করেন দেশের দুই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ।
প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা আবাসিক হলে সাধারণ শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। নির্মম নির্যাতনে অনেকেই গুরুতর আহত হচ্ছেন। নিহত হওয়ার ঘটনাও আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত পিটুনিতে বুয়েটে আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার ঘটনা। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি এএসএম আলী (শীতল) গুরুতর আহত হন।
সর্বশেষ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে আকতারুল ইসলাম নামে আরেক ছাত্র নির্যাতনের শিকার হন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখে ওই ছাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে একটি প্রশাসন আছে। প্রভোস্টের নেতৃত্বে সেই প্রশাসন ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার পাশাপাশি লেখাপড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করবেন বলেই তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এমনকি এই অভিজ্ঞতার জন্য পদোন্নতিতে তারা নম্বর পান। কিন্তু বর্তমানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রশাসন প্রভোস্টের হাতে নেই। ছাত্রদের হাতে চলে গেছে তা। এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশাসন থাকায় বুয়েটে আবরার ফাহাদকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট ঘটনাটিও এত বড় আকার ধারণ করেছে। সুতরাং যদি এই প্রশাসন শিক্ষকদের হাতে ফিরিয়ে আনা না হয়, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আকতারের মতো অজ্ঞান হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বা ছাত্রলীগের এই ভূমিকা সরকার বা আওয়ামী লীগকে কোনো সুবিধা দিচ্ছে না। বরং ক্ষমতাসীন দলকে বারবার বিব্রত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। বুয়েটে যদি নিয়ন্ত্রণ থাকত, তাহলে ফাহাদের সঙ্গে আরও দুডজন ছাত্রের জীবন এভাবে নষ্ট হতো না। হলগুলোতে নামকাওয়াস্তে প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটর আছেন। তাদের অনেকেই ঠিকমতো হলের খোঁজ নেন না। কোনোরকমে হলে গিয়ে অফিসে বসে চলে আসেন। ছাত্ররা কী খাচ্ছে, লেখাপড়া করতে পারছে কিনা, কী তাদের অসুবিধা আছে তা দেখছেন না। তবে এটা ঠিক যে, যেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে, সেখানে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটছে না। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আকতারের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেই নয়, দেশের ফৌজদারি আইনের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ। আকতারের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পাশাপাশি ফৌজদারি আইনে বিচার করা প্রয়োজন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে অন্য আবাসিক হলে স্বস্তি ফিরে আসবে।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, জাতীয় স্বার্থে এমনকি রাজনৈতিক স্বার্থেও আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তিকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। হল প্রশাসনকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতির নামে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না। হলে আসলে যেটা চলছে সেটা রাজনীতি নয়, দুর্বৃত্তপনা। এটা বন্ধ করতেই হবে।
আরেক বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম কালচার’ বলে একটা পরিভাষা শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের কোনো ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা উচিত নয়। এটা পরিচালনা করে ক্ষমতাসীন সরকারের সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো কাজই দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলতে কিছু নেই। গোটা হল চালানোর কথা প্রভোস্টদের। কিন্তু তা এখন চালায় ছাত্রলীগ। আর সরকার তা দেখেও না দেখার ভান করে। ছাত্র তারাই যাদের হাতে বই-খাতা-কলম থাকে, শ্রেণিকক্ষে বসে, গ্রন্থাগারে যায় এবং পরীক্ষা দেয়। ছাত্রলীগের যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের ছাত্রত্ব আছে কিনা বা এটা ছাত্রত্বের পর্যায়ে পড়ে কিনা-তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও সরকারের কাছে প্রশ্ন যে, আমার শিক্ষার্থীদের প্রতি গেস্টরুমে নিয়ে এমন অমানবিক আচরণ কেন করা হয়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক বলেন, গেস্টরুমে নির্যাতন বন্ধে একটি মাত্র কাজ করতে হবে। আর সেটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সত্যিকার অর্থে প্রশাসন চালাতে হবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন বলতে কিছু নেই। উপাচার্য তথা প্রশাসন চাইলে এসব অনাচার বন্ধ করতে একদিনও লাগে না। আমি উপাচার্য হলে তা করে দেখাতাম। বাংলা একাডেমিতে তা করে আমি দেখিয়েছি। আমি কিন্তু বাস্তব বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন থাকলে এমন ঘটনা তো হওয়ার কথা নয়।
