ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর
দেশ এগিয়েছে কিন্তু মাতৃভাষার গ্রগতি হয়নি: মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী
মানিক রাইহান বাপ্পী, রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামী মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। বয়স ৮৬ বছর। ছোট থেকেই রাজনীতি সচেতন। দশম শ্রেণিতে পড়াকালেই বুঝতে পারেন বাংলা মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা। এ ভাষাকে যদি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয় তাহলে জাতি অনেক পিছিয়ে যাবে। বাংলার স্থানে উর্দু হলে অনেক পিছিয়ে পড়বে বাঙালি জাতি। সুতরাং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন ড. এসএম বাপ্পা, গোলাম আরিফ টিপু, আতাউর রহমান। তাদের সংস্পর্শে থেকে ছাত্ররাজনীতি এবং ভাষাসংগ্রাম কমিটিতে যুক্ত হন। এরপর থেকেই রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল, মেস, হোস্টেলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রয়োজনীয়তা ও সংগ্রামে সশরীরে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন ভাষাসৈনিক আখুঞ্জী।
ভাষা আন্দোলনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা তুলে ধরে ভাষাসৈনিক মোশারফ হোসেন আখুঞ্জী যুগান্তরকে বলেন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করি। এর শুরুটা হয় ভাষা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। ভাষা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতি সত্তার উন্মেষ ঘটে। এরপর বাঙালির অধিকারের আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। তাই আমরা বলি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগৃহ।
আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম সে প্রত্যাশা বাংলায় অনেক পূরণ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও উন্নীত হয়েছি। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। দেশ এগিয়ে গেলেও বাংলা ভাষার তেমন উন্নতি হয়নি। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর। সুবর্ণজয়ন্তীতেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। উচ্চ আদালতের রায়গুলো এখনো অধিকাংশ ইংরেজিতে লেখা হয়। বাংলা ভাষাকে নামে মাত্র রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের দাবি, সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হোক। এটা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
সরকারের কাছে দাবি থাকবে-সারা বাংলাদেশের সাইনবোর্ডগুলো ইংরেজিতে থাকে।
আমি মনে করি, সেখানে বাংলা অবশ্যই থাকতে হবে, কেউ প্রয়োজন মনে করলে বাংলার নিচে ইংরেজি লিখতে পারে। আরও দুঃখজনক যে, বিজ্ঞানের পরিভাষা এখনো সম্পূর্ণ বাংলা হয়নি। অথচ আমাদের কাছাকাছি দেশ চীন, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়ায় নিজ নিজ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে। উচ্চ জ্ঞান-বিজ্ঞানেও মাতৃভাষা চর্চা করে। কিন্তু আমরা এখনো মান্ধাতা যুগে পড়ে আছি। শুধু আমরা সাহিত্য ও কবিতা পড়ি; কিন্তু বাংলাকে আমাদের জীবনমুখী করে গড়ে তোলার জন্য সেই চেষ্টাটুকুও করি না। তাই স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের কাছে দাবি থাকবে, বাংলার প্রতি হেলাফেলা না করে গুরুত্ব দেওয়া হোক। আমাদের বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি সেই হিসাবে পরিচয় হোক।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে এ ভাষাসৈনিক বলেন, প্রতিটা ইংলিশ মিডিয়ামে অবশ্যই বাংলা পাঠ্য হবে। বাংলায় পাশ না হলে পাশ হবে না-এ বিধান জারি করা উচিত। আমি মনে করি, বিজ্ঞানের কাজগুলো বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হোক। যেন অতি দ্রুত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বাংলায় করতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এ ভাষাসৈনিক বলেন, প্রতি বছর বারবার মহান ২১ ফেব্রুয়ারি জাতির জীবনে ফিরে আসে। বাঙালির বুকের রক্ত দিয়ে যারা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে দু-চার কথা বলে তাদের সাধুবাদ জানানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শত শত ভাষাসৈনিক নীরবে-নিভৃতে আর্থিক অনটনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। সমাজে নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছেন। কিন্তু আত্মসম্মানের কারণে নিজেকে কখনো সংকীর্ণ করে তুলতে চান না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।
সংগ্রামী এ ভাষাসৈনিকটির জন্ম ১৯৩৬ সালে। রাজশাহীর নগরীর লোকনাথ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে নীলফামারি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষাজীবন শেষ করেন। পারিবারিক জীবনে তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। কর্মজীবনে তিনি কিছু দিন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে চাকরি করেন। বর্তমানে নগরীর সাহেব বাজারের আরডিএ মার্কেটের ঐতিহ্যবাহী ‘মেসার্স ১ নম্বর গদী’ নামের মুদি দোকানের মালিক। পড়ালেখা করেই দিনের সিংহভাগ সময় কাটান এ ভাষাসৈনিক।
