করোনার নেতিবাচক প্রভাব
সম্পদ থেকে আয় কমেছে ব্যাংকের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ৮টি ব্যাংকের মুনাফায় শুভংকরের ফাঁকি পাওয়া গেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত প্রায় দুই বছরে করোনার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংক খাতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালেও আয় কমেছে বেশি। এর মধ্যে সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো রয়েছে লোকসানে।
সরকারিতে লোকসান কিছুটা কমলেও বিশেষায়িত ব্যাংকের লোকসান বেড়েছে। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর আয়ের হার আগের চেয়ে কমেছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য ছিল স্থবির। এরপর সব কিছু সচল হলেও এখনো আগের ধারায় ফেরেনি। গত দুই বছরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যক্রম ছিল স্থগিত। ফলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোনো গ্রাহককে খেলাপি করেনি। ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর মূল ঋণ যেমন আদায় হয়নি, তেমনি সুদ থেকেও অর্থ আদায় অনেক কম হয়েছে।
তবে গ্রাহকরা গত ২০ জানুয়ারি মধ্যে বকেয়া কিস্তির কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। অন্যথায় খেলাপি করা হচ্ছে। এভাবে নবায়ন করা ঋণের সুদ আদায় না হলেও তা আয় খাতে নিয়ে মুনাফা বাড়িয়েছে। এই কাগুজে মুনাফাও ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে কম হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকগুলোর পুঁজি থেকেও আয় কমেছে। ফলে সার্বিকভাবে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদ আদায় না করে তা আয় খাতে নিয়ে যাওয়া গুরুতর অপরাধ। এতে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হয়। মুনাফা স্ফীতভাবে দেখানো যায়। একটি পর্যায়ে গিয়ে আসল চিত্র বেরিয়ে আসে। তখন আর কিছু করার থাকে না। অতীতে দেশের কয়েকটি ব্যাংকে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই কঠোর হওয়া উচিত। তা না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, আয় না করেই মুনাফা ঘোষণা করে পরিচালকরা টাকা নিয়ে যাবেন। এদিকে আয় না হওয়ার কারণে টাকা যাবে আমানতকারীদের। ফলে আমানতকারীরা সংকটে পড়বে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারের মাধ্যমে কোনো সুদ আদায় না করে তা আয় খাতে নেওয়া যাবে না-মর্মে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের মার্চে ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে আয় ছিল ৪২ পয়সা। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ পয়সায়। সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে দাঁড়ায় ৪৪ পয়সায়। ডিসেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৫ পয়সায়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সম্পদ থেকে আয় ছিল ২৫ পয়সা। দুই বছরে আয়ের হার একই হলেও গড় মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে আয় ২০২০ সালের চেয়ে কমে যাচ্ছে।
২০২১ সালে গড়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। এ হার বাদ দিলে আয় ০.০২ শতাংশ কমে যাচ্ছে। ফলে ১০০ টাকায় আয় কমে দাঁড়াচ্ছে ২৩ পয়সায়। এর আগে ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে আয় অনেক বেশি ছিল। ২০১৭ সালে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে আয় হয়েছিল ৭০ পয়সা। ২০১৮ সালে ৩০ পয়সা এবং ২০১৯ সালে ছিল ৪০ পয়সা। করোনার কারণে গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারের আয় সর্বনিম্নে।
সূত্র জানায়, গত বছর ব্যাংকগুলো আয়ের যে চিত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উপস্থাপন করেছে তাতে কাগুজে মুনাফাও রয়েছে। অর্থাৎ সুদ আদায় না করেই তা আয় খাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী এখন থেকে আদায় না করে কোনো সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে কাগুজে আয় মুনাফা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশনার ফলে আয় আরও কমে যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে সরকারি ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে কোনো মুনাফা করতে পারেনি। বরং লোকসান হয়েছে ৬৮ পয়সা। ২০২০ সালে লোকসান ছিল এক টাকা ০৭ পয়সা। এক বছরে লোকসান কমেছে ৩৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গত বছরে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান দিয়েছে তিন টাকা ৩ পয়সা। ২০২০ সালে লোকসান ছিল তিন টাকা ০১ পয়সা। আলোচ্য সময়ে লোকসান বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে লোকসান হচ্ছে না, আয় হচ্ছে।
তবে আয় ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে কমেছে। ২০২১ সালে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা করেছে ৬২ পয়সা, ২০২০ সালে মুনাফা ছিল ৭০ পয়সা। ওই সময়ে মুনাফা কমেছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে মুনাফা কমেছে ৪৫ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে তারা ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা করেছে এক টাকা ১৭ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল দুই টাকা ১৩ পয়সা। করোনার কারণে ঋণ থেকে সুদ আদায় কম হওয়ার কারণেই ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশে যতগুলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে তার সবগুলোর নেপথ্যে ছিল প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে স্বাস্থ্য বেশি করে দেখানো। ব্যাংক এমনই একটি ব্যবসা যেখানে তথ্য বেশি দিন আড়াল করা রাখা যায় না। কোনো না কোনো ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কঠোর হওয়া উচিত।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মূলধন থেকে ব্যাংকগুলোর আয়ও কমেছে। গত বছরের মার্চে ১০০ টাকার মূলধন বিনিয়োগ করে আয় হয়েছিল ছয় টাকা ৭০ পয়সা, জুনে তা বেড়ে আট টাকা ২৬ পয়সা হয়, সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে সাত টাকা ৪২ পয়সায় দাঁড়ায়। ডিসেম্বরে আরও কমে চার টাকা ৪৪ পয়সা হয়। তবে ২০২০ সালের তুলনায় এ খাতে আয় বেড়েছে।
মূলধন থেকে মূলত বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো মুনাফা করেছে। সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো লোকসান দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো গত বছর ১০০ টাকার মূলধন থেকে মুনাফা করেছে ৯ টাকা ৩৪ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল ১০ টাকা ২২ পয়সা। বিদেশে ব্যাংকগুলোর মূলধন থেকে গত বছরে মুনাফা হয়েছে সাত টাকা ৫৯ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল ১৩ টাকা ২০ পয়সা।
