জোটের রাজনীতির হালচাল
ছন্দ নেই ১৪ দলীয় জোট শরিকদের
হতাশ জোটের শরিকরা : আ.লীগের প্রশাসননির্ভরতা এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় জোটে সমস্যা বাড়ছে
আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অভ্যন্তরে ছন্দ ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। শরিক দলগুলোর অনেকেই ক্ষুব্ধ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও জোটের সঙ্গে নেই বাংলাদেশ জাসদ। তারা বিকল্প জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি নিজেদের জোট সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে। এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের অন্তত ৭টি দলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েই চলছে। গত দুই বছরে জাতীয় কোনো ইস্যু বা নির্বাচনে ১৪ দলের জোটগত কোনো অবস্থান দেখা যায়নি। তবে সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে এই জোট আগামী জাতীয় নির্বাচনে একসঙ্গে অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গণভবনের ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তৃণমূলে ১৪ দলকে সংগঠিত করার জন্য দলীয় নেতাদের নির্দেশ দেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী জেলার নেতাদের একটি চিঠি পাঠালেও কার্যত ১৪ দলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। জোটের শরিক কয়েকটি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা যুগান্তরকে বলেন, জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অনাগ্রহ মূলত দায়ী। এ অনাগ্রহের পেছনে প্রধান দুটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো-ভোটের রাজনীতির সমীকরণ ও সরকারের প্রশাসননির্ভরতা। ভোট বাড়ানোর চেষ্টায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের বাম ও প্রগতিশীল দলগুলোর বিরোধ রয়েছে। ফলে এই শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব রাখতে হচ্ছে। আরেকটি কারণ হলো, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দেশ চালাতে গিয়ে প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, শরিকদের মধ্যে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, জাতীয় পার্টি- জেপির শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। জোটের শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্যই এরকম। তারা তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের আর দরকার নেই।
আওয়ামী লীগের এমন মনোভাব কেন জানতে চাইলে দিলীপ বড়ুয়া বলেন, এখন তো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। সেজন্য আওয়ামী লীগ হয়তো ভোটের হিসাব করছে। সেজন্য হেফাজতকে কাছে টানছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে না আমরা তাদের জন্য বোঝা নই, হেফাজতই তাদের জন্য বোঝা হবে। সর্বশেষ গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলকে শক্তিশালী করার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকটও ঘনীভূত হবে, ১৪ দলের ‘অ্যাকটিভিটি’ও দৃশ্যমান হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের চেয়ে হেফাজতে ইসলামের কদর বেশি। ফলে ১৪ দলের শরিকদের নিষ্প্রয়োজন মনে করে ক্ষমতাসীনরা। জোট এখন তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা। আমাদের জোটগত কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। শরিকরা যে যার পথে চলছে।’
আওয়ামী লীগের গাছাড়া মনোভাবের কারণে ১৪ দলের ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির জন্য ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করে জাসদ। দলটির সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার যুগান্তরকে বলেন, ‘ইদানীং ঐক্যের ক্ষেত্রে একটু ঢিলেঢালা অবস্থা দেখা যাচ্ছে। একদিকে সরকার প্রশাসন-আমলানির্ভর হয়ে দেশ পরিচালনা করছে; অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতিসহ যেসব বিষয়ে ১৪ দলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথা বলা দরকার, সেগুলোয় গাফিলতি দেখা যাচ্ছে। এই গাছাড়া ভাবটাই ঐক্যকে বিনষ্ট করে। আমরা মনে করি, এ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে। তবে আদর্শিক বিষয়গুলোকে ধারণ করে ঐক্য পরিচালনা না করলে এটা কাগুজে খেলনার মতো হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, বর্তমানে ১৪ দল নিষ্ক্রিয়। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো আগ্রহ নেই। জোটকে সক্রিয় করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেই।
তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ১৪ দলীয় জোটকে আরও বিস্তৃত করতে চায় আওয়ামী লীগ। জোটের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমাধান করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ অবশ্যই জোটের শরিকদের মূল্যায়ন করে। সেজন্যই একাধিক শরিক দলের নেতা মন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। বর্তমানে জোট নিষ্ক্রিয়-এ কথা সত্য নয়। গত দুই বছরে করোনার কারণে জোটের শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ কম হয়েছে। ১৪ দলের ঐক্য ছিল, আছে, থাকবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক ভিত্তির ওপরে গঠিত। অনেক সময় ছোটখাটো অভিমান, অভিযোগ ওঠে। এগুলো সময়মতো ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ১৪ দলে বিভক্তির কোনো আশঙ্কা নেই। বরং জোটের বাইরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে ১৪ দলে নিয়ে আসতে আমাদের আগ্রহ আছে।
এদিকে নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধ বাড়ায় ১৪ দলের কোনো কর্মসূচিতে থাকছে না বাংলাদেশ জাসদ। তবে তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়নি। জোটের বাইরে গিয়ে দলের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বাংলাদেশ জাসদের নেতারা। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দফায় জাসদ ভেঙে পৃথক দল গঠন হয়। এ দলগুলোর মধ্যে জেএসডি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। সাবেক জাসদ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্য নামে একটি দল গঠন করে সক্রিয় আছেন। বাংলাদেশ জাসদের পক্ষ থেকে এ দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গঠন বা একটি দলে একীভূত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
