দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নে বেড়েছে ফ্রিজের বাজার
jugantor
সাক্ষাৎকারে মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান
দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নে বেড়েছে ফ্রিজের বাজার

  যুগান্তর ডেস্ক   

০৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-সর্বত্র এখন বিদ্যুতের ছোঁয়া। এতে সহজ হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে ইলেকট্রনিক্স পণ্যসামগ্রী।

এর মধ্যে মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ। ছোট-বড় সব পরিবারেই ফ্রিজ একটি অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্র। এর ফলে দেশে ফ্রিজের চাহিদাও বেড়েছে। এ নিয়ে কথা বলছেন মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি এমএ রাজ্জাক খান রাজ।

যুগান্তর : ফ্রিজের ব্যবসায় আপনাদের যাত্রা কবে? কীভাবে এতদূর এলেন?

রাজ্জাক খান রাজ : ২০০২ সালে পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে সাদাকালো টেলিভিশনের মাধ্যমে মিনিস্টার ইলেকট্রনিক্সের যাত্রা শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা পাওয়ায় আমরা কালার টেলিভিশন ও ফ্রিজ তৈরি শুরু করি। ২০০৫ সালে ফ্রিজ অ্যাসেম্বলিং শুরু করেছি এবং ২০১৩ সাল থেকে আমরাই ম্যানুফ্যাকচারিং করছি। আমরা সফলতার সঙ্গে ২০ বছর পার করলাম। এই সফলতার পেছনে সব থেকে বড় অবদান ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার সহযোগিতায় আজ আমরা দেশীয়ভাবেই সব ধরনের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠার পর অল্পদিনেই দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ড হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করি এবং দেড় যুগ পেরিয়েও সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আমাদের কর্মীরা।

যুগান্তর : বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে বছরে ফ্রিজের চাহিদা কত?

রাজ্জাক খান রাজ : একটা সময় ছিল যখন দেশে ব্যবহৃত ফ্রিজগুলো আমদানি করা হতো। এখন সেই জায়গায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড। জনসাধারণের কাছে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ায় বিস্তৃত হয়েছে এর বাজারও। দেশে প্রতিবছর ২৫-৩০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। এটি চলতি বছর আরও বাড়বে বলে আমরা ধারণা করছি। একই সঙ্গে এ খাতে কর্মক্ষেত্রও বাড়ছে ব্যাপক হারে।

যুগান্তর : গত তিন বছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি কেমন ছিল। এ বছর কেমন প্রবৃদ্ধির আশা করছেন?

রাজ্জাক খান রাজ : করোনার প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণখেলাপিও হয়ে গেছে। শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিক্সসহ সব ধরনের তৈরি পণ্যই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে আমদানি হ্রাস পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু ক্রেতার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তিও বিদ্যমান থাকছে। এতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিল্প মালিকদের।

যুগান্তর : আপনাদের মার্কেট শেয়ার কতটুকু? গত বছর অভ্যন্তরীণ বাজারে আপনাদের প্রবৃদ্ধি কেমন হয়েছে?

রাজ্জাক খান রাজ : বর্তমান সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহরে পরিণত করা, কম খরচে দেশীয় ফ্রিজ কেনার সক্ষমতা এবং ফ্রিজ বিক্রির ব্যবস্থায় ক্রেতাবান্ধব শর্তাবলি (যেমন কিস্তিতে ক্রয়, গ্যারান্টি, পুরাতন দিয়ে নতুন নেওয়ার ব্যবস্থা, শূন্য শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ইত্যাদি) ফ্রিজ মার্কেট প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে পণ্যটি ব্যবহারের হার শহরের চেয়ে গ্রাম ও উপশহরগুলোয় এখন অনেক বেশি হারে বাড়ছে। বর্তমানে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারের প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় অন্যতম ব্র্যান্ড মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ। আগামীতে এই হার আরও বাড়বে বলে আশা করছি।

যুগান্তর : বাংলাদেশ থেকে ফ্রিজ রপ্তানির সম্ভাবনা কেমন, এ বাজার নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী? গত বছর আপনাদের রপ্তানি কেমন হয়েছে এবং কোন কোন দেশে আপনাদের রপ্তানি হচ্ছে?

রাজ্জাক খান রাজ : দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। ধীরে ধীরে ফ্রিজের আমদানিনির্ভরতা কমছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা করেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বাজার, পুঁজি, কারিগরি দক্ষতাসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধাই বিদ্যমান। সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে জোয়ার বইছে তাতে শামিল হতে হবে আমাদেরও। ফলে এ শিল্পকে আরও চাঙা রাখতে ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনসহ এসব পণ্যের দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

যুগান্তর : প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ বাজারে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী? সরকারের কাছে কী ধরনের নীতিসহায়তা আশা করেন?

রাজ্জাক খান রাজ : ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে আজকের এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে আমাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিগত সরকারের নানা ধরনের নিয়মনীতি, কম্পিটিউটরদের এগ্রেসিভ মার্কেটিং, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ইত্যাদি। তার পরও বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় আমাদের এই ইলেকট্রনিক্স শিল্প অনেকটা এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে টেকনিক্যাল লোকবলের প্রয়োজন। এছাড়া আমাদের পণ্য যেহেতু ইলেকট্রিক্যাল সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করায় দেশের প্রতিটি জায়গায় আমাদের পণ্য ব্যবহার করতে পারছে। উন্নয়নের এ ধারা বজায় রাখতে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে নীতিসহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি।

যুগান্তর : দেশের ফ্রিজ শিল্পে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, এ বাজারে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

রাজ্জাক খান রাজ : বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্প বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। দেশের জনপ্রিয় ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম মিনিস্টার গ্রুপ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে বেসরকারি খাত। তার মধ্যে ইলেকট্রনিক্স শিল্পও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য খাতের বিকাশের ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। এ শিল্প হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। আমরা আগামী দুই বছরে পুরো বিশ্বে আমাদের ইলেকট্রনিক্স পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

যুগান্তর : নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও গবেষণায় আপনারা কেমন বিনিয়োগ করছেন?

রাজ্জাক খান রাজ : আমাদের সব পণ্য বিশ্বমানের প্রযুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ দেশেই তৈরি করা হয়। বৈশ্বিক বাজারে ইলেকট্রনিক্সের অনেক বড় বড় কোম্পানির নাম রয়েছে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিশ্বখ্যাত এসব ব্র্যান্ডের পণ্য সুপরিচিত, বাংলাদেশেও সহজলভ্য। কিন্তু এ দেশে বাজার দখলের লড়াইয়ে সবাইকে টেক্কা দিচ্ছে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড মিনিস্টার গ্রুপ। প্রতিনিয়তই চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিজ, টেলিভিশন ও এসি। গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রিক পণ্যসহ মিনিস্টারের সব পণ্য দেশেই তৈরি হয়।

যুগান্তর : ফ্রিজ তথা ইলেকট্রনিক শিল্প এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কী সহায়তা দিতে পারে?

রাজ্জাক খান রাজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে। এর পুরো সুফল পেয়েছে দেশের ইলেকট্রনিক্স এবং প্রযুক্তি শিল্প। তবে করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্যের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশের দাম ব্যাপক বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাতে। এ অবস্থায় স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে আমদানি ও রাপ্তানিতে ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন। তা না হলে এসব পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যা ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তাই আমরা আশা করছি, এই খাতে সরকার শিল্পবান্ধব নীতিসহায়তা ও কাঁচামাল আমদানি সহজ করবে।

যুগান্তর : আপনাদের ফ্রিজের বিশেষত্ব কী? বাজারে আপনাদের কতগুলো পণ্য আছে?

রাজ্জাক খান রাজ : বিভিন্ন দামে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ তৈরি করে থাকে মিনিস্টার। মিনিস্টারের রয়েছে স্পেসিফিকেশন, আকৃতি, ডিজাইন। প্রতিটি পণ্যের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করেই দামের ভিন্নতা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব প্রযুক্তি, যা সঠিক তাপমাত্রা-হিমায়িত খাবারের ভিটামিন এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে। সম্পূর্ণ অটোমেটিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ফ্রিজ। একই সঙ্গে ৬৬% এনার্জি সেভিং কম্প্রেসার ব্যবহার করা হয়। যার ফলে প্রতিটি ফ্রিজ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। মিনিস্টারের প্রডাকশন লাইনে রয়েছে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, এলইডি টিভি, স্মার্ট এলইডি টিভি, ব্লেন্ডার, গ্রিন্ডার, রাইসকুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক ক্যাটলি, গ্যাস বার্নার, ইন্ডাকশন কুকার, ফ্রাইপেন, ফ্যান, আয়রন, স্টাবিলাইজারসহ ২০টিরও বেশি পণ্য।

যুগান্তর : আপনাদের কারখানা কোথায়। মোট কতজন কর্মী আছে?

রাজ্জাক খান রাজ : গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে সবুজ অরণ্যে সুবিশাল পরিসরে মিনিস্টার গ্রুপের ২টি কারখানা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মিনিস্টারের করপোরেট অফিস। এসব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কর্মী রয়েছে মিনিস্টার গ্রুপে।

সাক্ষাৎকারে মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান

দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নে বেড়েছে ফ্রিজের বাজার

 যুগান্তর ডেস্ক  
০৬ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-সর্বত্র এখন বিদ্যুতের ছোঁয়া। এতে সহজ হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে ইলেকট্রনিক্স পণ্যসামগ্রী।

এর মধ্যে মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ। ছোট-বড় সব পরিবারেই ফ্রিজ একটি অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্র। এর ফলে দেশে ফ্রিজের চাহিদাও বেড়েছে। এ নিয়ে কথা বলছেন মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি এমএ রাজ্জাক খান রাজ।

যুগান্তর : ফ্রিজের ব্যবসায় আপনাদের যাত্রা কবে? কীভাবে এতদূর এলেন? 

রাজ্জাক খান রাজ : ২০০২ সালে পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে সাদাকালো টেলিভিশনের মাধ্যমে মিনিস্টার ইলেকট্রনিক্সের যাত্রা শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা পাওয়ায় আমরা কালার টেলিভিশন ও ফ্রিজ তৈরি শুরু করি। ২০০৫ সালে ফ্রিজ অ্যাসেম্বলিং শুরু করেছি এবং ২০১৩ সাল থেকে আমরাই ম্যানুফ্যাকচারিং করছি। আমরা সফলতার সঙ্গে ২০ বছর পার করলাম। এই সফলতার পেছনে সব থেকে বড় অবদান ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার সহযোগিতায় আজ আমরা দেশীয়ভাবেই সব ধরনের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠার পর অল্পদিনেই দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ড হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করি এবং দেড় যুগ পেরিয়েও সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আমাদের কর্মীরা। 

যুগান্তর : বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে বছরে ফ্রিজের চাহিদা কত? 

রাজ্জাক খান রাজ : একটা সময় ছিল যখন দেশে ব্যবহৃত ফ্রিজগুলো আমদানি করা হতো। এখন সেই জায়গায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড। জনসাধারণের কাছে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ায় বিস্তৃত হয়েছে এর বাজারও। দেশে প্রতিবছর ২৫-৩০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। এটি চলতি বছর আরও বাড়বে বলে আমরা ধারণা করছি। একই সঙ্গে এ খাতে কর্মক্ষেত্রও বাড়ছে ব্যাপক হারে।

যুগান্তর : গত তিন বছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি কেমন ছিল। এ বছর কেমন প্রবৃদ্ধির আশা করছেন?

রাজ্জাক খান রাজ : করোনার প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণখেলাপিও হয়ে গেছে। শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিক্সসহ সব ধরনের তৈরি পণ্যই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে আমদানি হ্রাস পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু ক্রেতার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তিও বিদ্যমান থাকছে। এতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিল্প মালিকদের। 

যুগান্তর : আপনাদের মার্কেট শেয়ার কতটুকু? গত বছর অভ্যন্তরীণ বাজারে আপনাদের প্রবৃদ্ধি কেমন হয়েছে?

রাজ্জাক খান রাজ : বর্তমান সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহরে পরিণত করা, কম খরচে দেশীয় ফ্রিজ কেনার সক্ষমতা এবং ফ্রিজ বিক্রির ব্যবস্থায় ক্রেতাবান্ধব শর্তাবলি (যেমন কিস্তিতে ক্রয়, গ্যারান্টি, পুরাতন দিয়ে নতুন নেওয়ার ব্যবস্থা, শূন্য শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ইত্যাদি) ফ্রিজ মার্কেট প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে পণ্যটি ব্যবহারের হার শহরের চেয়ে গ্রাম ও উপশহরগুলোয় এখন অনেক বেশি হারে বাড়ছে। বর্তমানে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারের প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় অন্যতম ব্র্যান্ড মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ। আগামীতে এই হার আরও বাড়বে বলে আশা করছি। 

যুগান্তর : বাংলাদেশ থেকে ফ্রিজ রপ্তানির সম্ভাবনা কেমন, এ বাজার নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী? গত বছর আপনাদের রপ্তানি কেমন হয়েছে এবং কোন কোন দেশে আপনাদের রপ্তানি হচ্ছে? 

রাজ্জাক খান রাজ : দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। ধীরে ধীরে ফ্রিজের আমদানিনির্ভরতা কমছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা করেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বাজার, পুঁজি, কারিগরি দক্ষতাসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধাই বিদ্যমান। সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে জোয়ার বইছে তাতে শামিল হতে হবে আমাদেরও। ফলে এ শিল্পকে আরও চাঙা রাখতে ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনসহ এসব পণ্যের দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

যুগান্তর : প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ বাজারে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী? সরকারের কাছে কী ধরনের নীতিসহায়তা আশা করেন?

রাজ্জাক খান রাজ : ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে আজকের এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে আমাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিগত সরকারের নানা ধরনের নিয়মনীতি, কম্পিটিউটরদের এগ্রেসিভ মার্কেটিং, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ইত্যাদি। তার পরও বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় আমাদের এই ইলেকট্রনিক্স শিল্প অনেকটা এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে টেকনিক্যাল লোকবলের প্রয়োজন। এছাড়া আমাদের পণ্য যেহেতু ইলেকট্রিক্যাল সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করায় দেশের প্রতিটি জায়গায় আমাদের পণ্য ব্যবহার করতে পারছে। উন্নয়নের এ ধারা বজায় রাখতে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে নীতিসহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি।

যুগান্তর : দেশের ফ্রিজ শিল্পে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, এ বাজারে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সম্ভাবনা কেমন দেখছেন? 

রাজ্জাক খান রাজ : বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্প বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। দেশের জনপ্রিয় ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম মিনিস্টার গ্রুপ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে বেসরকারি খাত। তার মধ্যে ইলেকট্রনিক্স শিল্পও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য খাতের বিকাশের ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। এ শিল্প হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। আমরা আগামী দুই বছরে পুরো বিশ্বে আমাদের ইলেকট্রনিক্স পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

যুগান্তর : নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও গবেষণায় আপনারা কেমন বিনিয়োগ করছেন?

রাজ্জাক খান রাজ : আমাদের সব পণ্য বিশ্বমানের প্রযুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ দেশেই তৈরি করা হয়। বৈশ্বিক বাজারে ইলেকট্রনিক্সের অনেক বড় বড় কোম্পানির নাম রয়েছে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিশ্বখ্যাত এসব ব্র্যান্ডের পণ্য সুপরিচিত, বাংলাদেশেও সহজলভ্য। কিন্তু এ দেশে বাজার দখলের লড়াইয়ে সবাইকে টেক্কা দিচ্ছে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড মিনিস্টার গ্রুপ। প্রতিনিয়তই চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিজ, টেলিভিশন ও এসি। গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রিক পণ্যসহ মিনিস্টারের সব পণ্য দেশেই তৈরি হয়। 

যুগান্তর : ফ্রিজ তথা ইলেকট্রনিক শিল্প এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কী সহায়তা দিতে পারে?

রাজ্জাক খান রাজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে। এর পুরো সুফল পেয়েছে দেশের ইলেকট্রনিক্স এবং প্রযুক্তি শিল্প। তবে করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্যের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশের দাম ব্যাপক বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাতে। এ অবস্থায় স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি খাতে আমদানি ও রাপ্তানিতে ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন। তা না হলে এসব পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যা ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তাই আমরা আশা করছি, এই খাতে সরকার শিল্পবান্ধব নীতিসহায়তা ও কাঁচামাল আমদানি সহজ করবে। 

যুগান্তর : আপনাদের ফ্রিজের বিশেষত্ব কী? বাজারে আপনাদের কতগুলো পণ্য আছে?

রাজ্জাক খান রাজ : বিভিন্ন দামে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ তৈরি করে থাকে মিনিস্টার। মিনিস্টারের রয়েছে স্পেসিফিকেশন, আকৃতি, ডিজাইন। প্রতিটি পণ্যের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করেই দামের ভিন্নতা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব প্রযুক্তি, যা সঠিক তাপমাত্রা-হিমায়িত খাবারের ভিটামিন এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে। সম্পূর্ণ অটোমেটিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ফ্রিজ। একই সঙ্গে ৬৬% এনার্জি সেভিং কম্প্রেসার ব্যবহার করা হয়। যার ফলে প্রতিটি ফ্রিজ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। মিনিস্টারের প্রডাকশন লাইনে রয়েছে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, এলইডি টিভি, স্মার্ট এলইডি টিভি, ব্লেন্ডার, গ্রিন্ডার, রাইসকুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক ক্যাটলি, গ্যাস বার্নার, ইন্ডাকশন কুকার, ফ্রাইপেন, ফ্যান, আয়রন, স্টাবিলাইজারসহ ২০টিরও বেশি পণ্য। 

যুগান্তর : আপনাদের কারখানা কোথায়। মোট কতজন কর্মী আছে?

রাজ্জাক খান রাজ : গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে সবুজ অরণ্যে সুবিশাল পরিসরে মিনিস্টার গ্রুপের ২টি কারখানা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মিনিস্টারের করপোরেট অফিস। এসব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কর্মী রয়েছে মিনিস্টার গ্রুপে।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন