Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সরকার ও বিরোধীদের পালটাপালটি অবস্থান

রিজার্ভ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরকার ও বিরোধীদের পালটাপালটি অবস্থান

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। পালটাপালটি অবস্থান নিয়েছে সরকার ও বিরোধীরা।

চুরি, অপব্যবহার ও লুটপাটের কারণে রিজার্ভের অর্থ কমে এই মুহূর্তে বেশ ঝুঁকিতে পড়েছে-এমন নানা অভিযোগ মাঠের বিরোধী দল বিএনপির।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা বলছে, রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারে সরকার অনেক সাশ্রয়ী, বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে, এর মাধ্যমে দেশের মুদ্রা সাশ্রয় করা হয়েছে, রিজার্ভ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আর অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকারের অসতর্কতামূলক সিদ্ধান্তের কারণে রিজার্ভ কমে গেছে। এতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ঝুঁকিতে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। অতীতে কখনোই রিজার্ভ নিয়ে এত বিতর্ক হয়নি।

এমনকি রিজার্ভ কখনো রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়ও ছিল না। এখন সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয়ও হয়ে উঠেছে রিজার্ভ। অথচ আগে রিজার্ভ নিয়ে শুধু গণমাধ্যম ও অর্থনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোয়ই আলোচনা হতো।

সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় টাকার মান কমে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। কষ্টে পড়েছে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের মানুষ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রবল চাপে পড়েছে। এসব কারণে জুলাই থেকে রিজার্ভ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। আগস্টে এ বিতর্ক আরও বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বর থেকে তা তুঙ্গে ওঠে, যা এখনো চলমান।

রিজার্ভ নিয়ে আগস্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব দেওয়া শুরু করেছেন। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীসহ সরকারি দলের একাধিক নেতা রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেছেন। এর বিপরীতে বিএনপির ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. মঈন খানসহ বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ প্রসঙ্গে নানা মন্তব্য করে যাচ্ছেন।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছরের আগস্টে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে রিজার্ভের অর্থ কমতে থাকে। বর্তমানে রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ৪২০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এখান থেকে ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৬২০ কোটি ডলার।

সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রিজার্ভের টাকা দিয়ে বিমান ক্রয় করা হয়েছে। নদী ড্রেজিং করা হয়েছে। কিছু কিছু বিনিয়োগ করা হয়েছে। রিজার্ভের টাকা নিয়ে বসে থাকলে হবে না, দেশের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে হঠাৎ একটা কথা এসেছে-রিজার্ভ, রিজার্ভ, রিজার্ভ। রিজার্ভের টাকা নাকি সব চুরি হয়ে গেছে। চুরিটা হয় কীভাবে? আমি ৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি, তার আগে বিএনপি ছিল। তখন রিজার্ভ ছিল ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। সেটা আমরা বাড়িয়ে প্রায় ৩-৪ বিলিয়নে নিয়ে আসি। ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন রিজার্ভ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার।

এই ৫ বিলিয়ন থেকে আমরা প্রায় ৪৮ বিলিয়নের কাছাকাছি ওঠাতে পেরেছি। তিনি আরও বলেছেন, সবচেয়ে বড় কথা, আমরা ভ্যাকসিন কিনেছি। যখন মাত্র রিসার্চ হচ্ছে, তখনই ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে দিয়েছি, যাতে যেটাই সফল হয়, সেটা নিতে পারি, দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারি। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা ৮ বিলিয়ন ডলার আলাদাভাবে বিনিয়োগ করেছি। আমাদের বিমানের ঝরঝরে অবস্থা ছিল। সব থেকে আধুনিক বিমান কিনেছি কয়েকটি। এর জন্য অন্যের কাছ থেকে ধার নিইনি। কারণ ধার নিলেও সুদসহ শোধ দিতে হতো। সুদসহ পুরোটাই দেশে থাকছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রপ্তানিতে আমরা প্রণোদনা দিচ্ছি। সেখানেও আমাদের লোকই লাভবান হচ্ছে। এখন অতি মূল্য দিয়ে খাদ্য, তেল, গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এখানে টাকা নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। দেশের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে।’

বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৪ বিলিয়নে নেমে আসা নিয়ে আলোচনার মধ্যে বিএনপি আমলের সঙ্গে এখনকার রিজার্ভের তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেনে, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে রিজার্ভ পেয়েছিল আড়াই বিলিয়ন ডলারের মতো, পাঁচ বছরে সেটাকে বাড়িয়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল।

রিজার্ভ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন-সরকার রিজার্ভ থেকে কতিপয় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়েছে। সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকার মতো রিজার্ভের অর্থও লুটপাট করেছেন।

বিএনপির এসব সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রিজার্ভ নিয়ে টানা অপপ্রচার করে যাচ্ছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকার কখনো রিজার্ভ থেকে এক পয়সাও নষ্ট করেনি। বরং দেশ ও জনগণের স্বার্থে এই টাকা ব্যবহার করে। রিজার্ভ একটু কমবে-বাড়বে। এটা নিয়ে নানারকম মন্তব্য ও গুজব ছড়াচ্ছে। রিজার্ভের টাকা কেউ চিবিয়ে খায়নি।

জবাবে বিএনপির ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রিজার্ভের টাকা চিবিয়ে খাননি। গিলে খেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিরোধীরা অর্থাৎ বিএনপি বলে যে, রিজার্ভের টাকা কোথায় গেল? অবশ্যই আমরা জিজ্ঞাসা করতে চাই, রিজার্ভের টাকা কোথায় গেল? তিনি (প্রধানমন্ত্রী) উত্তর দিয়েছেন, রিজার্ভের টাকা কি চিবিয়ে খায়? আমরা বলছি, চিবিয়ে তো খাননি, রিজার্ভের টাকা গিলে ফেলেছেন।’

ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, পায়রা বন্দরে খরচ করা হয়েছে। কিন্তু পায়রা বন্দরে খরচ করার জন্য রিজার্ভের টাকা না। রিজার্ভের টাকা হচ্ছে যখন বাইরে থেকে পণ্য আমদানি করবেন, সেই টাকা ডলারে পরিশোধ করবেন। রিজার্ভের টাকা হচ্ছে দেশে যখন অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে, তখন সেই সংকট দেখবে।’

গত ১ নভেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে বিএনপি। এ ধরনের জালিয়াতিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র সম্পর্কে সরকারের মিথ্যাচারের নিকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে করছে দলটি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইএমএফ’র হিসাব মতে, বাংলাদেশে জুন ২০২১-এর শেষদিকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার তা ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলেছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে তথ্য জালিয়াতি দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র সম্পর্কে সরকারের মিথ্যাচারের নিকৃষ্ট উদাহরণ।

এর জবাবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই কমে গেলেও এখনো তা বিএনপির আমলের তুলনায় ১২ গুণ বেশি।

সরকার রিজার্ভ গিলে খেয়েছে বলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার জবাবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতিতে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং বিশ্বচোর হিসাবে খেতাব পাওয়া বিএনপি এখন বড় গলায় কথা বলছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিজার্ভ নিয়ে প্রথম কথা ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে। ওই সময়ে তা ৮৮ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। ওই সময় বিরোধী দল থেকেই অভিযোগ উঠে রিজার্ভ শূন্য করে ফেলা হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তখন কিছুই বলা হয়নি। এরপর ২০০১ সালের শেষদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময়ে রিজার্ভ কমে ৯৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ওই সময়ে বিরোধী দল ও পরবর্তীকালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ নিয়ে কিছু কথা বলেছিল। এরপর রিজার্ভ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রিজার্ভ বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে। চালের দাম বাড়তে থাকলে সমালোচনা করা হয়-রিজার্ভ রেখে কী লাভ। রিজার্ভ দিয়ে চাল আমদানি করলেই হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-চাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে হবে। এলসির দেনা শোধ করা হবে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে। কিন্তু ওই সময়ে আমদানিকারকরা চাল আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল কম। যে কারণে আমদানি কমেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রিজার্ভ বাড়াতে থাকে। ওই সময় রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এরপর থেকে তারা রিজার্ভ বাড়াতে থাকে। তখন রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় এ ধরনের আলোচনা ছিল। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখায় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। দীর্ঘদিন চলে এই সমালোচনা। ২০২১ সালে রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আবার সমালোচনা শুরু হয়। করোনাকালীন গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে নতুন রেকর্ড গড়ে। ওই সময়ে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলার, যা দিয়ে সাড়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। ওই সময়েও রিজার্ভ নিয়ে ‘তৃপ্তির ঢেকুর’ তোলা হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। এতে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যায়। গত আগস্ট থেকে রিজার্ভ কমে রোববার তা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২০ কোটি ডলার। নিট হিসাবে ২ হাজার ৬২০ কোটি ডলার, যা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন তহবিলে ৮০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পরোক্ষ দায়। টাকা আদায় না হলে এগুলো যে কোনো সময় প্রত্যক্ষ দায়ে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ওইসব অর্থ বাদ দেওয়া উচিত। আইএমএফও এ বিষয়টিকে এবারের আলোচনায় বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে তহবিলে বরাদ্দ ও বিনিয়োগ করা অর্থ রিজার্ভে রাখা ঠিক হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এগুলো রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া।

তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ হচ্ছে আন্তর্জাতিক উপাদান। একে আন্তর্জাতিক হিসাবের সঙ্গে মিলিয়েই রাখতে হবে। এ জন্য আইএমএফ’র একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। সে মানটিই অনুস্মরণ করা শ্রেয়। তা না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে।

সরকার .বিরোধী. পালটাপালটি .অবস্থান.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম