মহান ভাষার মাস
বইমেলায় প্রচুর বই চাই শিশুদের জন্য
সেলিনা হোসেন
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একুশের বইমেলা বাঙালি জাতির জন্য একটি অসাধারণ দিগন্ত। আমি মনে করি, এই দিগন্ত ছুঁয়ে বড় হয়ে উঠবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এ প্রজন্মের মাঝে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটবে, যে বিকাশে আমাদের সুন্দর-সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা তৈরি হবে, সেই মূল্যবোধের কোথাও খারাপ কিছু থাকবে না। এভাবেই বইমেলা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সাংস্কৃতিক চেতনাকে আলোকিত ও সমৃদ্ধ করে তুলবে।
একুশের বইমেলা শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে, আমি সেটি মনে করি না। বইমেলাকে সারা দেশে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ কাজ বাংলা একাডেমি করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন হবে সরকারি উদ্যোগের। দেশের প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমির শাখা রয়েছে। জেলা পর্যায়ে একুশের বইমেলা অনুষ্ঠানের জন্য তাদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কলেজ, স্কুল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে সপ্তাহব্যাপী বা পক্ষকালব্যাপী বইমেলা আয়োজন করা যেতে পারে স্থানীয় বাস্তবতার আলোকে।
বইমেলা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই আমি মনে করি, একুশের বইমেলাকে তৃণমূল তথা গ্রামপর্যায়ে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এটা এই সময়ের অন্যতম দাবিও।
আমি বাংলা একাডেমিতে ৩৪ বছর চাকরি করার সময়ের ভেতরেই একুশের বইমেলাকে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে দেখেছি। একজন মাত্র প্রকাশক, ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে যে মেলার সূচনা ঘটেছিল, তা কালের দাবিতে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। আজ বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও তাকে স্থান করে দিতে হচ্ছে।
একুশের বইমেলায় আমি দেখেছি কৌতূহলী পাঠকরা খুঁজে খুঁজে বই কিনছেন, যাঁর যে বিষয়ে আগ্রহ, তিনি সেই বিষয়ের বইয়ের জন্য স্টলে স্টলে ধরনা দিচ্ছেন। আবার জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস এবং অটোগ্রাফের জন্য কোনো কোনো স্টলে ক্রেতাদের লাইন দিয়ে বই কেনা-এসবই বইকে কেন্দ্র করে আমাদের আবেগ এবং আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। এ আবেগ এবং আগ্রহকে মূল্য দিতে হবে। আমি দেখেছি অনেক মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য বই কিনছেন, বই পাঠে আগ্রহী শিশুরা বইয়ের জন্য তাদের কাছে দাবি জানাচ্ছে, আবদার করছে।
বইমেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমি অনেক কৌতূহলী পাঠকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা অনেকে আমাকে বলেছেন, বইমেলা তাদের মধ্যে পাঠতৃষ্ণা জাগিয়েছে, তাদের পাঠতৃষ্ণা পূরণে সহায়ক হয়েছে। বই খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য সহজ হয়েছে। বইমেলা তাদের বই পাঠে অনুপ্রাণিত করেছে, তাদের সন্তানদের মাঝে সঞ্চারিত হয়েছে বইপড়ার অভ্যাস। বইমেলার আয়োজনকে তাঁরা সাধুবাদ জানিয়েছেন।
অনেকেই তাঁদের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেছেন, বইমেলা থেকে বই কিনে ঘরে ফিরে তারা সন্তানদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, ‘বাবা কেবল তোমার জন্য বই কেন কেন? আমরা কি বই পড়তে পারি না? আমার জন্য বই আনো না কেন?’ বলাই বাহুল্য, বইমেলা এভাবেই আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততির সঙ্গে সম্পর্কের সেতু তৈরি করে দিয়েছে।
এখানেই একুশের বইমেলার স্বাতন্ত্র্য ও শক্তি। এসব অভিজ্ঞতা আমি আমার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুমহলে বলেছি, তাদের বলেছি, শিশুদের হাতে বই তুলে দিতে-শিশুদের জন্য বই সবচেয়ে সেরা উপহার। তাদের জীবন, কল্পনাশক্তি, মনন গঠনে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
তবে গভীর পরিতাপের বিষয় যে, বইমেলাতে অনেক বই বের হয়, প্রতিবছর প্রায় ৪-৫ হাজার, কিন্তু এই বিপুল গ্রন্থরাজির মধ্যে শিশুদের বই বের হয় হাতেগোনা। আমি প্রায় ২০ বছর বাংলা একাডেমির কিশোরদের পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’ সম্পাদনা করেছি। আমি চেষ্টা করেছি, শিশুদের জন্য বেশি বেশি বই প্রকাশের।
‘ধান শালিকের দেশ’-এ প্রকাশিত উপন্যাসকে আমি বাংলা একাডেমি থেকে শিশুদের বই হিসাবে বের করার কাজে উদ্যোগী ছিলাম। বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক আমার সাবেক সহকর্মী, আমাদের জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রতি আমি অনুরোধ জানাই, তিনি যেন বাংলা একাডেমি থেকে শিশুদের বই প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেন।
আমি দেশের প্রকাশকদের প্রতিও একটা অনুরোধ জানাতে চাই, তারা যেন শুধু বড়দের জন্য বই প্রকাশের গণ্ডিতে আটকে না থাকেন। আমার মনে হয়, তাদের সবারই উচিত ছোটদের বই প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। প্রত্যেক প্রকাশকের বইয়ের অর্ধেক না হলেও অন্তত ৩০-৩৫ ভাগ বই শিশুদের জন্য প্রকাশ করা প্রয়োজন বলে আমার বিশ্বাস। একই সঙ্গে আমি লেখকদের প্রতিও বলতে চাই, শিশুদের জন্য তাদের সবার লেখা উচিত। প্রচুর লেখা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই ছোটদের জন্য লেখাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়, আমরা তার ব্যতিক্রম। মেলায় যাতে শিশু এবং নারীরা বেশি আসতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
