সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগ আমলে ভোট চুরির সুযোগ নেই
‘যিনি এত নামিদামি তার জন্য ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে বিজ্ঞাপন দিতে হবে কেন’ * এমন কোনো চাপ নেই যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে * রমজানে দ্রব্যমূল্যের কষ্ট লাঘবে ব্যবস্থা
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে ভোট চুরির সুযোগ নেই। কিন্তু এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেক আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এজেন্সি উন্মুখ হয়ে আছে। ৪০ জনের নামে (ওয়াশিংটন পোস্টের বিজ্ঞাপন) যেটা এসেছে, তার পেছনেও কিছু অ্যাম্বিশন আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিরও চেষ্টা হচ্ছে। হয়তো সাময়িক কিছু একটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেটা মোকাবিলা করবে আমাদের জনগণই।
কাতার সফর নিয়ে সোমবার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে ৪ থেকে ৮ মার্চ এই সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। লিখিত বক্তৃতার পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
এ সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির চলমান আন্দোলন ও দলটিকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংলাপের প্রয়োজনীয়তাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট আমার বাবা-মাকে হত্যা, গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা, এরপরও তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে। কিন্তু তারা এরপরও একের পর এক অপমান করে গেল। এত অপমানের পর তাদের সঙ্গে কিসের বৈঠক?
তিনি বলেন, ‘আমার পরিষ্কার কথা, যারা এটুকু ভদ্রতা জানে না তাদের সঙ্গে বৈঠকের কি আছে। কেউ পারবেন বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের সঙ্গে এইভাবে বসে বৈঠক করতে। যেটুকু সহ্য করেছি, দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়।’
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, ‘গত নির্বাচনে সংলাপ করেছি, রেজাল্টটা কি, নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ ছাড়া কিছুই করেনি। ৩০০ আসনে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে টাকা খেয়েছে। এরপর নিজেরা নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, টানা ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করছি। দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছি। এর মধ্যেও কিছু অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। এটা দীর্ঘ সময় এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। এখন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পালা। যদিও এখনো অনেক ঘটনা ঘটছে, এসবের জন্য সাময়িক সমস্যা হতে পারে। তবুও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
রোহিঙ্গারা বোঝা, ১৯৭১ সালে এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল
শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বোঝা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি শরণার্থী বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই কথাগুলো মনে করেই মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত? কিন্তু তাদের মধ্যে সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
রমজানে দ্রব্যমূল্যের কষ্ট লাঘবে ব্যবস্থা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যেন কষ্ট না হয় সেজন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা এখন আর পরনির্ভরশীল নই। নিজেরাই উৎপাদন করছি। আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত আছে। আশা করি রমজানে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে কেউ খাদ্যপণ্য মজুত করে পচিয়ে ফেললে কিছু করার থাকবে না। সেদিকে সাংবাদিকদেরও একটু নজর রাখতে হবে।
কোনো চাপ নেই
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন কোনো চাপ নেই যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে আমার শক্তি একমাত্র আমার জনগণ। আর উপরে আল্লাহ আছেন। তিনি বলেন, আমার বাবার আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় ওপরে আছে। কাজেই কে কী চাপ দিল না দিল, তা নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। জনগণের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে যা কিছু করার তা আমি করব। এরকম বহু চাপ আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ৭০ বছর বয়সেও একটা লোক এমডি থাকতে চায়, সেই চাপও শেখ হাসিনা সহ্য করেছেন বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করেছি
আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম নির্বাচন কমিশন করার জন্য আইন করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সবসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে ছিল, আওয়ামী লীগই প্রথম নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করে দিয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা চায় না
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো করুণা বা দাক্ষিণ্য চায় না। বরং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের ন্যায্য পাওনা চায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সফরে কোভিড অতিমারি ও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য নেওয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি।
এখন আর ভোট কারচুপির সুযোগ নেই
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আর ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। আমরা ছবিসহ ভোটার তালিকা করে দিয়েছি। এনআইডি যুক্ত করা হয়েছে। ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ নেই। আমরা ইভিএমে ভোট করতে চেয়েছিলাম, অনেকে আপত্তি করেছেন। এতে সবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট দিতে পারতেন, ফলাফলও সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যেত। কিন্তু এটি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, আমরা বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। নির্বাচন কমিশন যতটা সম্ভব ইভিএম ব্যবহার করবে। ভোটাররা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট দেবেন।
ববির ফুল দিতে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই
৭ মার্চ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে। সংবাদ সম্মেলনে ববির বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ ববির ফুল দিতে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। পরিবারের সদস্য হিসাবে ফুল দিয়েছে সে (ববি)।’
সমালোচনা শুনেই যাচ্ছি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিনিয়ত সমালোচনা শুনেই যাচ্ছি। আমরাই সুযোগ করে দিয়েছি। এর আগে তো এত টেলিভিশন ছিল না, এত রেডিও ছিল না। আমরাই সব উন্মুক্ত করে দিয়েছি। কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ। দেশ-বিদেশে বসে বসে আমাদের সমালোচনা করে। আমাদের করে দেওয়া জিনিস দিয়ে আমাদের সমালোচনা করে। আবার শুনতে হয় কিছুই করিনি।
নতুন রাষ্ট্রপতি একজন পোড় খাওয়া মানুষ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন রাষ্ট্রপতির প্রশংসা করে বলেছেন, তার (মো. সাহাবুদ্দিন) মধ্যে দায়িত্ববোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশপ্রেম ও ব্যক্তিত্ব আছে। আমরা চাইব যেন অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। তারও সব সময় এই প্রচেষ্টাই থাকবে। কারণ গণতন্ত্রের জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি। সেজন্য তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়াউর রহমান তাকে গ্রেফতার করে ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে রেখেছিলেন। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী।
তেল-বিদ্যুৎ-পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে
ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, পানি ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘গরম আসছে, সেই সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। গ্রামেও বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। সেজন্য সবাইকে বলব বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হবেন।’
খাদ্যাভ্যাস ধীরে ধীরে বদলানো উচিত
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে সবার খাদ্যাভ্যাস ধীরে ধীরে বদলানো উচিত। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আপনারা গণভবনে ঢুকে দেখতে পেয়েছেন সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবকিছুর ব্যবস্থা করেছি। জমি অনাবাদি না রেখে সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে হবে। আমার নিজের ছাদের ওপর ছোট চেরি, টমেটো গাছ লাগিয়েছি। গাছে প্রচুর টমেটো ধরেছে। সকালে নাস্তায় টমেটো আর পনির খেয়েছি। কাজেই খাওয়ার অভ্যাসটাও আমাদের ধীরে ধীরে বদলানো উচিত।’
৪০ বিদেশির বিবৃতি বিজ্ঞাপন
৪০ জন বিদেশি ব্যক্তির বিবৃতিকে বিজ্ঞাপন বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা বিবৃতি না, এটা একটা বিজ্ঞাপন। যে ৪০ জনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে একজন বিশেষ ব্যক্তির পক্ষে। এর উত্তর কী দেব, জানি না। আমার একটা প্রশ্ন আছে, যিনি এত নামিদামি নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত, তার জন্য এই ৪০ জনের নাম খয়রাত করে এনে বিজ্ঞাপন দিতে হবে কেন? তাও আবার বিদেশি পত্রিকায় (ওয়াশিংটন পোস্ট)।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে যাই হোক। দেশে কতগুলো আইন আছে। সে আইন অনুযায়ী সব চলবে এবং সেটা চলে। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। শ্রমিকদের অধিকার আমরা রক্ষা করি, ট্যাক্স বিভাগ আছে আলাদা। তারা সেটি আদায় করে। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেয়, শ্রম আদালত আছে। এই ক্ষেত্রে আমার তো কিছু করার নেই সরকারপ্রধান হিসাবে।’
বাংলাদেশ ও কাতারের সম্পর্ক ঢেলে সাজানোর আহ্বান
বাংলাদেশ ও কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দুদেশের সরকারের মধ্যে একটি যৌথ ব্যবসা ও বিনিয়োগ কমিটি এবং দুদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বয়ে একটি যৌথ বিজনেস ফোরাম গঠনের প্রস্তাব করেছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামুদ্রিক গ্যাস অনুসন্ধান, জ্বালানি সঞ্চালন ব্যবস্থা, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন, স্টার্টআপসহ বিভিন্ন খাতে কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সফরে আমি মিয়ানমারে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে আরও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে জাতিসংঘের সহযোগিতা চাই।
