ভূমিকম্পে কাঁপল ঢাকা, বড় দুর্বিপাকের পূর্বাভাস
মার্কিনিরা বলছে উৎপত্তিস্থল দোহারে, ভারতীয় সংস্থার মতে নারায়ণগঞ্জে * ফল্টলাইনের বাইরে এই ভূমিকম্প
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় শুক্রবার মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। তবে কোথাও ক্ষয়ক্ষতি কিংবা প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। খুব ভোরে মানুষজন যখন হাঁটতে বা কাজে বের হচ্ছিলেন কিংবা ফের ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সে সময় তারা কম্পন অনুভব করেন।
ঢাকার খুব কাছেই ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। এ সম্পর্কে দুটি বক্তব্য পাওয়া গেছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, ঢাকার দোহার উপজেলায় ছিল এর কেন্দ্র। আর ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সংস্থার মতে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারের মাঝামাঝি স্থানে ছিল এর কেন্দ্র।
জানতে চাইলে বুয়েটের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী যুগান্তরকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নারায়ণগঞ্জেই হবে। কেননা এর আগে গত ২৫ এপ্রিল একই স্থানে ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থার তথ্যটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
ঢাকার আশপাশে ভূমিকম্পের বড় ফল্টলাইন বা ভূচ্যুতিরেখা আছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে। এছাড়া সিলেটে আছে আরেকটি। এর আগে ১৮৮৫ সালে মধুপুরে ৭ দশমিক ১ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হয়। এটি ঢাকা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া সিলেটের ফল্টলাইনে ১৯১৮ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার অপর ভূমিকম্প হয়। বেঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত ১৮৮৫ সালের ওই ভূমিকম্পে যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। এখন মধুপুরে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। অন্যদিকে সিলেটে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে। কিন্তু ঢাকার এত কাছে কোনো ফল্টলাইন আছে বলে এতদিন জানা যায়নি। তাহলে এই দুটি ভূমিকম্প কেন হচ্ছে?
এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মেহেদী আহমদ বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প ফল্টলাইনের বাইরে হয়ে থাকে। আর সাধারণত বড় ভূমিকম্পের আগে এ ধরনের ছোট ভূমিকম্প হয়। তাছাড়া বড় একটি ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পরে পুনরায় একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ক্ষেত্রে মাঝখানে দেড় থেকে দুইশ বছর সময়ের পার্থক্য হয়। মধুপুর এবং সিলেট ভূমিকম্পের ‘রিটার্ন পিরিয়ড’ (পুনরায় দুর্ঘটনা) কাছাকাছি-এমনই বার্তা দিচ্ছে এসব ছোটখাটো ভূমিকম্প। আর ফিরতি ভূমিকম্পও আগের মাত্রায়ই হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ মরে না। মানুষ মরে ভবনের কারণে। তাই ছোট ভূমিকম্পগুলো আমলে নিয়ে জানমাল রক্ষায় এখনই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি করতে হবে। আর যেগুলো আছে সেগুলো পরীক্ষা করে ‘রেক্টোফিটিং’ (ভূমিকম্প সহনীয়) করতে হবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, ভূমিকম্পটি হালকা মাত্রার ছিল। এর উৎপত্তিস্থলে ভূভাগের ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল। যদি আরও গভীরে এর কেন্দ্র থাকত তাহলে কম্পন আরও বেশি অনুভূত হতো।
ইউএসজিএসের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্বে। উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকার আজিমপুরের দূরত্ব ২৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার উত্তর-উত্তর-পূর্বে এবং নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ২৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর-পূর্বে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকার দোহারে ও তার আশপাশের এলাকায় কয়েকটি ছোট নদী আছে। সেগুলো মূলত এক ধরনের ভূচ্যুতি। এমন চ্যুতিগুলো দিয়ে ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় এ ধরনের ভূমিকম্পের প্রক্রিয়াকে ‘নিওটেকটনিক’ বলা হয়। সাধারণত নিওটেকটনিক চ্যুতি থেকে বড় ভূমিকম্প হয় না।
প্রসঙ্গত, দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে আছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। আর আবহাওয়া অধিদপ্তর বাংলাদেশকে ভূকম্পনের তিনটি জোনে ভাগ করেছে। সম্প্রতি পরিচালিত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। এই সমীক্ষাটি চার বছর (২০১৮ থেকে ২০২২ সাল) ধরে করা হয়।