তদন্তে সময় বাড়ল ৫ দিন
এডিসি হারুনকে নিয়ে পুলিশে তীব্র মতানৈক্য
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শাহবাগ থানায় ওসির (তদন্ত) কক্ষে ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনায় পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ মনে করছে, সেই রাতে ঘটনা যা ঘটেছে, তার চেয়ে বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এমনটি করা হচ্ছে। অন্য একটি পক্ষের বক্তব্য, এডিসি হারুন-অর-রশীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। আগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ঘটনায় তাকে জবাবদিহির আওতায় না আনায় তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাহিনীর সুনাম বাড়বে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার বক্তব্যেও উঠে এসেছে হারুন ইস্যুতে মতানৈক্যের ইঙ্গিত। এসব নিয়ে পুলিশের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপেও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শনিবার রাতে আলোচিত এই ঘটনার পর থেকে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
ডিএমপির তিন সদস্যের একটি দল ঘটনার সূত্রপাত, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকের ভূমিকা নিরূপণে কাজ করছে। পুলিশ সূত্র জানায়, এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে দুই দিনের সময় দিয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনার। কিন্তু তদন্তের পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় তারা আরও পাঁচ দিন সময় পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপির ডিসি মো. ফারুক হোসেন। ইতোমধ্যে কমিটি এডিসি হারুন-অর-রশীদ, এডিসি সানজিদা আফরিন, পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফা, ঘটনার মূল ভুক্তভোগী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম, আরেক আহত ছাত্রলীগের বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিমসহ অন্তত ১০ জনের বক্তব্য নিয়েছে। এডিসি সানজিদা আফরিনের স্বামী রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক খান মামুনকে চিঠি দিয়ে বক্তব্য নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, এডিসি হারুন ও সানজিদা তদন্ত কমিটির কাছে এ ঘটনার মূল দায় দিয়েছেন এপিএস মামুনের ওপর। অন্যদিকে ঘটনার ভুক্তভোগীরা পুলিশের কমিটির কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত ও নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। কমিটি নাঈম ও মুনিমের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই ছাত্রের এ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পেয়েছে। তদন্ত কমিটি তাদেরও বক্তব্য গ্রহণ করবে। অপরাধের মাত্রা নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে তারা। এখন পর্যন্ত যেসব সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে এডিসি হারুন ও পরিদর্শক মোস্তফার সেদিন সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকায় থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আহত ছাত্রলীগের নেতাদের পক্ষ থেকে হামলায় ১০-১৫ জনের অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও তদন্তে এখন পর্যন্ত ৮-১০ জনের নাম পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘অত্যন্ত নির্মোহভাবে এ ঘটনার তদন্ত চলছে। সেদিন যা ঘটেছিল, তদন্তে তাই উঠে আসবে।’
এদিকে এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা। এখন পর্যন্ত এডিসি হারুন-অর-রশীদের চাকরিচ্যুতির দাবি ছাড়া প্রায় সব দাবিই পূরণ হয়েছে। ছাত্রলীগ, পুলিশ ও সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ঘটনাটি ঘিরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেটি নিশ্চিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। এজন্য ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শাহবাগ থানা ফটকে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করলে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এর পরদিন এডিসি হারুনকে রমনা জোন থেকে প্রত্যাহার করে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজম্যান্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়। আবার সেদিনই তাকে এপিবিএন-এ বদলি করা হয়। এ নিয়ে আপত্তি উঠলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এ নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ তাকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অনেকটা শান্ত হয়েছেন।
এসব ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের অন্তত তিনটি গ্রুপে আলোচনা-সমালোচনার তথ্য পেয়েছে যুগান্তর। যেখানে এ সংক্রান্ত সংবাদের লিংক এবং বিভিন্ন মন্তব্য শেয়ার করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন কেউ কেউ। অনেকে আবার একেবারেই চুপ থেকেছেন। অনেক পুলিশ সদস্য মতামত তুলে ধরে নিজেদের মধ্যে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে মেসেজ চালাচালি করছেন।
ঘটনাপরম্পরায় পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের দাবি, এডিসি হারুনের ওপর এপিএস মামুন শুরুতে আক্রমণ করেছেন। বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে হারুনের বিরুদ্ধে এভাবে একের পর এক ‘অ্যাকশন’ নেওয়ায় পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে যাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশকে নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য তাদের কর্মপরিবেশে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া ঘটনাটির সঙ্গে পুলিশ সদস্য সম্পৃক্ত থাকায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অন্য ক্যাডারের অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক) একজন সরকারি কর্মকর্তা। উনি আমাদের পুলিশের ওপর হামলাটি করেছেন। তিনি তো ইচ্ছা করলে আমাদের (পুলিশ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন, অবহিত করতে পারতেন। অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। সেটি না করে হাসপাতালের ভেতরে অসংখ্য মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করা, তার চশমা ভেঙে ফেলা, তার ওপর আঘাত করা-এটা সঠিক করেছেন কি না, আমি জানি না। তবে এটা তদন্ত হওয়া উচিত।’
এদিকে এই বক্তব্যের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমি কিছু বলতে পারব না। এখন হারুন (গোয়েন্দা প্রধান) এই তথ্য কোথায় পেল, সেই বলতে পারবে।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের অপর একটি অংশ মনে করে, এডিসি হারুনের অপরাধকে পুলিশবাহিনীর অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করা কখনোই সমীচীন হতে পারে না। এখানে এক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের দ্বন্দ্বেরও কোনো বিষয় নেই। অপরাধ করলে অপরাধী হিসাবে তার বিচার হবে। এ ঘটনায় অন্য রং দিয়ে একটি পক্ষ মূলত এডিসি হারুনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সরকার ও পুলিশ প্রশাসন অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা নিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছে। অথচ এ ঘটনায় একটি পক্ষ এতটাই অতি উৎসাহী ভূমিকায় রয়েছে যে, তারা বিভিন্ন গ্রুপেও সুকৌশলে এডিসি হারুনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে মারামারি : এদিকে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের আগে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে মারামারি হয় এডিসি হারুন ও এপিএস মামুনের মধ্যে। ঘটনার পরদিন রোববার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলীর দেওয়া চিঠিতে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। তিনি চিঠিতে লেখেন, শনিবার রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে আসা একদল দর্শনার্থী ইটিটি (এক ধরনের শারীরিক পরীক্ষা) কক্ষের সামনে মারামারি করেন। হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শন করে এসে তিনি এই মারামারি দেখতে পান। দুপক্ষকে অনুরোধ করে তিনি মারামারি থামাতে সমর্থ হন।
