১৮ দিনের হরতাল-অবরোধ
অর্থনীতির ক্ষতি লাখ কোটি টাকার বেশি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার পর অর্থনীতি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়েছে। এতে একদিকে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমেছে। ফলে অর্থনীতিতে বহুমুখী ক্ষতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে সারা দেশে ১৮ দিনের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এসব কর্মসূচির কারণে প্রতিদিন গড়ে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ১৮ দিনে সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিবহণ খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। পণ্য পরিবহণ ও মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ক্ষতি ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
দেশে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনসপিসহ সমমনা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সোমবার পর্যন্ত দুদফায় সারা দেশে ৩ দিনের হরতাল ও সাত দফায় ১৫ দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বুধবার থেকে অষ্টম দফায় অবরোধ ও হরতাল শুরু হয়েছে। এছাড়া আঞ্চলভেদেও হচ্ছে হরতাল। এসব কর্মসূচির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পরিবহণ খাতের। সরাসরি ক্ষতির চেয়ে পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে আরও বেশি। এরপরেই রয়েছে পর্যটন খাত। পাশাপাশি কৃষি, পাইকারি ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। বড় শিল্পেও উৎপাদন কমে গেছে। রপ্তানি আদেশ কম আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে অর্থনীতির তত বেশি ক্ষতি হবে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে বেশিমাত্রায়। এ কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি ও ব্যবসায়ীরা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছেন। তা না হলে ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনীতিতে নানা ধরনের বিধিনিষেধও আসতে পারে।
এফবিসিসিআইর এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ দিনের অবরোধ বা হরতালে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। ১০১৪-১৫ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় প্রতিদিন ক্ষতি হতো ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। এখন অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে। একটির সঙ্গে অপরটির সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এসব কারণে ক্ষতির পরিমাণও বেশি হচ্ছে।
এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এভাবে অর্থনীতির ক্ষতি হতে থাকলে এক সময় ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সিমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ১ দিনের অবরোধ বা হরতালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে। তাদের বিক্রি কমে যাচ্ছে। এতে কমছে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে শিল্পোৎপাদন কমেছে। জুলাইয়ে শিল্পোৎপাদন বেড়েছিল ১৯ শতাংশ। আগস্টে বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা সামান্য বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটে শিল্প খাতের ওপর দিয়ে যে ধকল যাচ্ছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার ধকল।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য খাতে এ অস্থিরতার ফলে খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই তখন ঋণ নবায়নে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। এর সুযোগ নেবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে মন্দার কারণে ঋণের প্রবাহ কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ২ দশমিক ০৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিনিয়োগ কম হওয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগের গতি ফিরতে আরও বেশি সময় লাগবে। এর সঙ্গে যোগ হবে বৈশ্বিক বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি আরোপের হুমকি দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা গার্মেন্ট খাতেও শ্রম আইন প্রয়োগের কথা বলেছে। এতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এলে ক্ষতির মিছিল আরও দীর্ঘ হবে। একই সঙ্গে দেশের ইমেজ সংকট প্রকট হবে।
রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি গত অর্থবছর থেকে কমে আসছে। চলতি অর্থবছরেও কমছে। গত অর্থবছরে এ খাতে কাঁচামাল আমদানি কমেছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। এলসি খোলা কমেছে ২ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত ৫-৬ মাসে রপ্তানিমুখী শিল্প বৈশ্বিক মন্দায় ব্যবসা হারিয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। এর ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এতে বিদেশি ক্রেতারা শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। তারা নতুন অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। শীতের শেষ ভাগ ও বসন্তকালীন অর্ডারগুলো এখন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন অর্ডার কম আসছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবহণ খাতে। গণ ও পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মানুষের চলাচল যেমন কমে গেছে, তেমনি পণ্য পরিবহণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি জানিয়েছে, হরতাল ও অবরোধে পরিবহণ খাতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এটি শুধু পরিবহণ খাত সংশ্লিষ্ট ক্ষতি। এর বাইরে পণ্য পরিবহণ ও মানুষের চলাচল খাতেও আরও বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এসব খাতে প্রতিদিনের ক্ষতি এক হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ১৮ দিনে এ খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধ শুরুর পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ২২২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। এ খাতটির করোনার সময় থেকে ক্ষতি মোকাবিলা করে আসছে। এখন আবার নতুন করে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে কৃষি পণ্যে। পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এদিকে ঝুঁকি নিয়ে পরিবহণ চালাতে গিয়ে ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। ট্রাকপ্রতি গড়ে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ভাড়া। এতে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় মাঠপর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলে একদিকে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন সব উদ্যোক্তার মধ্যেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এটি দীর্ঘ সময় থাকবে বলে তারা মনে করছেন। ফলে অনেকে নির্বাচনের পরও কোনো বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন না। এতে সার্বিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়বে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেকার তরুণরা। কারণ তারা করোনার সময় থেকে প্রত্যাশিত চাকরি পাচ্ছেন না। এরপর বৈশ্বিক মন্দা, ডলার সংকটেও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতায় এ নেতিবাচক প্রভাব আরও দীর্ঘায়িত হবে।
হরতাল-অবরোধের কারণে যানবাহন চলাচল কম করায় বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের চলাচলে খরচ বেড়েছে। একদিকে তাদের আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে খরচ। ফলে জীবন মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সম্প্রতি চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেন খালেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অবরোধে নাশকতার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পরিবহণ খাত। ফলে পরিবহণ ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা পরিবহণ শ্রমিকরা। এ খাতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে কম-বেশি সবাই আক্রান্ত হচ্ছে।
এর আগে ২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের পর ব্যবসায়ী সংগঠনের করা এক জরিপে বলা হয়, একদিনের হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পোশাক খাতে ক্ষতি ৩৬০ কোটি টাকা। সরকারি রাজস্ব খাতে ১ দিনের ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা। পাইকারি মার্কেট, শপিংমল ও অন্যান্য শপে ১ দিনের হরতাল-অবরোধে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকা। আর্থিক ও ভ্রমণ খাতে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা। যাতায়াত খাতে ক্ষতি ৬০ কোটি টাকা। উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি ও আর অন্যান্য খাতে ১ দিনের ক্ষতি ৬৫ কোটি টাকা।