Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জাহাজ নির্মাণে ৩০০ মিলিয়ন ডলার

অজ্ঞাত ঋণজালে বিএসসি

Icon

কাজী জেবেল

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অজ্ঞাত ঋণজালে বিএসসি

বিদেশি বেসরকারি খাত থেকে তিনশ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ। ওই চুক্তি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সই হয়নি। চুক্তি সই হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যেটি অন্যদের থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেবে। কোন দেশ, ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকে এই অঙ্কের ঋণ আসবে-তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে নারাজ ওই প্রতিষ্ঠানটি। তবুও ওই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে চট্টগ্রামের একটি ব্যাংকে ৫৬৫ কোটি টাকা ব্লক করেছে বিএসসি। শিপিং করপোরেশনের ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে এই টাকা ব্লক করতে ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামক চুক্তিও করেছে। বিদেশি ঋণ গ্রহণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অনুমোদন ও প্রক্রিয়া অবলম্বন ছাড়াই এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বিএসসি। আর এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সম্মতি ও অনুমোদন দিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএসসি চুক্তি সই করেছে তা হলো-‘এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফসোর পিটিআই লিমিটেড।’ এ প্রতিষ্ঠানের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

আরও জানা গেছে, এআইএস মেরিন নামক প্রতিষ্ঠানটি কখনোই জাহাজ নির্মাণ করেনি এবং তাদের এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। বিএসসি বাদে বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণের জোগানও দেয়নি। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজ মেরামত সেবা দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ঋণের টাকায় বিএসসির জন্য ৬টি কনটেইনার জাহাজ নির্মাণ করা হবে। জাহাজ নির্মাণ তদারকি এবং ঋণের ৩০০ মিলিয়ন ডলার জোগান দেওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানটি ‘ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল সার্ভিস ফি’ বাবদ নেবে প্রকল্প ব্যয়ের ১.৩ শতাংশ ডলার। অর্থাৎ তিনশ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হলে ওই প্রতিষ্ঠানটি পাবে ৩.৯ মিলিয়ন ডলার।

নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এআইএস মেরিনের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে গত দুই বছরে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ২৪ জানুয়ারি এআইএস মেরিনের ঋণ প্রস্তাবে ছাড়পত্র বা মতামত চেয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) চিঠিও দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে এই ঋণ প্রস্তাবকে ‘সহজ শর্তের ও অত্যন্ত নমনীয়’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ওই চিঠিতে এআইএস মেরিনের সঙ্গে নন-বাউন্ডিং এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) স্মাক্ষরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘অ্যাগ্রিমেন্ট ফর জেনারেল ইউজ’ এবং ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অ্যাগ্রিমেন্ট ফর জেনারেল ইউজ’ স্বাক্ষরের কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়নি। ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, এই ধরনের ঋণ প্রস্তাবে তারা বিস্মিত হয়েছেন। ইআরডি থেকে এ ধরনের ঋণপ্রস্তাবে ছাড়পত্র দেওয়ার সাম্প্রতিক নজির তাদের জানা নেই। তারা বলেন, অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এভাবে ঋণচুক্তি সই করতে পারে কিনা-তা নিয়েও সন্দিহান তারা।

অ্যালোকেশন অব বিজনেস ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়কে ২৬ ধরনের কার্যক্রমের কথা বলা আছে। ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়টি সেখানে উল্লেখ নেই।

বিএসসির সংশ্লিষ্ট একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিএসসি এ পর্যন্ত যেসব ঋণ নিয়েছে বা ঋণ নেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে তার সবই জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে নেওয়া হয়েছে। দুই হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি জাহাজ নির্মাণে চীনের সঙ্গে কমার্শিয়াল চুক্তিও হয়েছে। একই পদ্ধতিতে কোরিয়া থেকে ছয়টি কনটেইনার জাহাজ সংগ্রহের আলোচনা চলমান রয়েছে। শুধু এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফসোর মাধ্যমে বেসরকারি খাত থেকে ঋণ নেওয়ার চুক্তি হয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে সুদ হার ০.৫৫ শতাংশ। তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছরে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এ প্রকল্পে শেষ পর্যন্ত ঋণ মিলবে কি না এবং ঋণ না মিললে ব্যাংকে ব্লক করে রাখা ৫৬৫ কোটি টাকা ফেরত আনা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, আমরা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইআরডিতে চিঠি দিয়েছি। আমরা নন-বাউন্ডিং এমওইউ করেছি। কোনো চুক্তি করিনি। তিনি বলেন, এই ঋণের সুদ মাত্র ০.৫৫ শতাংশ, যা সবচেয়ে কম। জাহাজ চালিয়ে যে আয় হবে তা থেকে ঋণের টাকা শোধ করা হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও বিএসসির এক টাকাও খরচ হবে না। এই ঋণ আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

ঋণের টাকা কোন উৎস থেকে আসবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এআইএস মেরিন একটি জয়েন্টভেঞ্চার ধরনের প্রতিষ্ঠান। তারা ব্যাংক বা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে ঋণের টাকার জোগান দেবে। তারাই জাহাজ নির্মাণ করে দেবে। ঋণের টাকা পরিশোধ হলে জাহাজের মালিকানা বিএসসিকে বুঝিয়ে দেবে।

এসব বিষয় নিয়ে ‘এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফসোর পিটিআই লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত এআইএস মেরিনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) মো. আরিফুল ইসলামের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় কথা হয়। এক পর্যায়ে মো. আরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিএসসির সঙ্গে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট ফর জেনারেল ইউজ’ এবং ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামক পৃথক দুটি চুক্তি একইদিনে সই করেছি। এ দুটি চুক্তিই বাণিজ্যিক ও গোপনীয়। তাই আমরা এই চুক্তির শর্ত ও প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারব, আমরা ফান্ড জোগাড় করে দেব এবং জাহাজ নির্মাণে কারিগরি সহায়তা দেব। বিএসসি তাদের পছন্দের শিপইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণ করতে পারবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চুক্তি সই অনুষ্ঠানে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিএসসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক সই করেন।

কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে এই তিনশ মিলিয়ন ডলার ঋণ জোগান দেওয়া হবে-তা নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমাদের খুবই গোপনীয় তথ্য। আমরা নামকরা ব্যাংক ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করি। এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারব না। ব্যাংকিং চ্যানেলে ঋণের টাকা শিপইয়ার্ডে চলে যাবে। শিপইয়ার্ড জাহাজ বানাবে। ওই জাহাজ বিএসসি পাবে। এখানে কোনো কালো টাকা নেই। পুরো টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হবে। এখানে স্বচ্ছতা থাকবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ঋণের টাকার জোগান দেওয়ার হাজারো পথ রয়েছে।

ঋণের পুরো টাকা অস্ট্রেলিয়া থেকে জোগান দেওয়া হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না। কিছু অস্ট্রেলিয়া থেকে আবার কিছু টাকা অন্য দেশ থেকে আসতে পারে। যেহেতু এটা জিটুজি চুক্তি নয়, তাই অস্ট্রেলিয়া থেকেই এ টাকার জোগান দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর বা অন্য দেশে থাকলে সেখান থেকে টাকার জোগান দেওয়া হবে। তবে পুরো টাকাই ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমরা ঋণের ব্যবস্থা করিনি। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা করি। বাংলাদেশে ব্যবসা করা খুবই কঠিন। আমরা বিএসসিকে উপকারের জন্য ঋণ প্রস্তাব করছি।

বিএসসির বহরে আরও জাহাজ যুক্তের জন্য ঋণ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান সংস্থাটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক। তবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এই ঋণ প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি নন তিনি। এ বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সরকারের প্রতিটি লেভেলে অনুমোদন ছাড়া এই ঋণ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করব না। আমি অথেনটিসিটি ও লেজিটেমিসি নিশ্চিত করেই এ বিষয়ে এগোব। কোন উৎস্য থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে তা বিএসসি জানে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারা ঋণ দেবে তা আমার জানা নেই। আমরা যাদের সঙ্গে চুক্তি করেছি, তারাই টাকা ম্যানেজ করে এনে দেবে। কোথা থেকে আনবে সেটা তাদের বিষয়। যেহেতু আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব নিয়েছি বেশিদিন হয়নি, তাই এর বেশি বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ৫৬৫ কোটি টাকার ফান্ড ব্লক করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রামের একটি শাখায় এই টাকা ব্লক করা হয়েছে। এজন্য বিএসসি সুদ বাবদ ৫০-৬০ কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। ১৩ মাসের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ঋণের টাকা না এলে ওই টাকা আবার আমাদের অ্যাকাউন্টে চলে আসবে। সেভাবেই চুক্তিতে বলা আছে।

তিনি জানান, এই মুহূর্তে বিএসসির বহরে সাতটি জাহাজ রয়েছে। আরও জাহাজ সংগ্রহ করা খুবই দরকার। বিএসসি গত বছরে ৬০০ কোটি টাকা আয় করেছে। নিট মুনাফা করেছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। বিএসসির বহরে আরও জাহাজ থাকলে আয় আরও বেশি হবে।

ঋণজাল বিএসসি জাহাজ নির্মাণ মিলিয়ন ডলার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম