Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস নিয়ে দুর্নীতির মহোৎসব

বছরে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বছরে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাতে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। বছরে এ খাতে প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্র্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হন বাস মালিক-শ্রমিকরা। বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দল এবং বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের। ৩৫ শতাংশ নারী যাত্রী যৌন হয়রানির শিকার। ২২ শতাংশ শ্রমিক মাদক বা নেশা করে গাড়ি চালান।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে মঙ্গলবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেট এই খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এই আঁতাতের সামনে সরকারও ক্ষমতাহীন। পরিস্থিতি উত্তরণে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সংস্থার উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান, মোহাম্মদ নূরে আলম ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুহা. নূরুজ্জামান ফরহাদ।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাত আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত। গবেষণার তথ্য অনুসারে, বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দল এবং বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের। এতে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাত্রীবান্ধব গণপরিবহণের পরিবর্তে মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়েছে। এ জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে সিন্ডিকেট। তিনি বলেন, জিম্মিদশা এতটাই প্রকট, মালিক-শ্রমিকের আঁতাতের কারণে তাদের আচরণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। এতে একদিকে যাত্রীদের প্রত্যাশিত সেবা মিলছে না, অন্যদিকে সাধারণ শ্রমিকরাও তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত।

ড. জামান বলেন, বাস পরিবহণ ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেন হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে। বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা রাখতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতা ঢাকতে তারা জনবল সংকটকে সামনে আনছে। বিআরটিএ-এর অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের সবই চলছে যোগসাজশে। এখানে সংশ্লিষ্ট সবাই অনৈতিক সুবিধার অংশীদার। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত জরুরি। তিনি বলেন, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা আরও বিকশিত হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এখানে দুর্নীতির মহোৎসবের মূল কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়। মালিক সংগঠনের নেতাদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জরিপে অংশ নেওয়া ২২টি (১৩ দশমিক এক শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে। বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষমতাসীন এবং ১২ শতাংশ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতাচর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ত করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাস পরিবহণে অনিয়ম ও দুর্নীতির আরও প্রকট হওয়ার উদাহরণ হচ্ছে-জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী-শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৯ শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২৪ শতাংশ কর্মী-শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই। ২২ শতাংশ বলেছে, বাসের রুট পারমিট নেই। তাছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসে পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সধারী চালকের সংকট আছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বাস মালিক জানান, তাদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক পেশাদার লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক আছেন। ২২ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিকের তথ্যানুযায়ী, মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান, কন্ডাক্টর ও হেলপার বা সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া চলন্ত বাসে চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। এতে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বাস পরিবহণে অনিয়মের উদাহরণের মধ্যে আরও রয়েছে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত আসন সংযোজন, নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় প্রভৃতি। জরিপে অংশ নেওয়া সিটি সার্ভিসের ৮৯ দশমিক দুই শতাংশ এবং আন্তঃজেলার ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ কর্মী-শ্রমিকের মতে, তাদের কোম্পানির বাসে নিয়ম অনুযায়ী টায়ার, ইঞ্জিন ওয়েল, ব্রেক-সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি প্রভৃতি পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বাসের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত না করায় তাদের গাড়ি রাস্তায় কালো ধোঁয়া নিঃসরণ করে। অনেকক্ষেত্রে মালিকরা নকশা পরিবর্তন করে বাসে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করে। সিটি সার্ভিসের কর্মী-শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছেন, তাদের গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী যাত্রী কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন। দূরপাল্লার ও আঞ্চলিক বাসে এ হার ৩১ দশমিক তিন শতাংশ। সিটি সার্ভিসে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ সহযাত্রী এবং ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ বাসের স্টাফ দ্বারা। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসাবে দিতে বাধ্য হন বাস মালিক ও কর্মী-শ্রমিকরা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হয়। এছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও টোকেন বাণিজ্যের জন্য বাস মালিক ও কর্মী-শ্রমিকরা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হলো নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ এবং হালনাগাদ বাবদ ঘুস। বাস মালিক-শ্রমিকদের বিআরটিএকে বছরে ঘুস দিতে হয় ৯শ কোটি টাকার বেশি।

এ সময়ে বাস পরিবহণ ব্যবসায় সুশাসন নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ করে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে বাস কোম্পানিগুলোকে অনানুষ্ঠানিক নিয়োগ বন্ধ করে শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী কর্মী নিয়োগ, প্রয়োজনীয় নীতিমালা (অর্থ ও প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জেন্ডার, অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন, তথ্য উন্মুক্তকরণ, ক্রয়, টিকিট ইত্যাদি সংক্রান্ত) প্রণয়ন ও তা তদারকির আওতায় আনা। এছাড়াও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম