কৃচ্ছ্রসাধনের ধাক্কা উন্নয়ন প্রকল্পে
বছরে খরচ হয়নি ১৬ হাজার কোটি টাকা
৩৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিলের এ অর্থ অব্যয়িত ছিল * প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চলমান সংকটে কৃচ্ছ্রসাধনের ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন প্রকল্পে। এক বছরে (২০২২-২৩ অর্থবছর) সরকারি তহবিলের প্রায় ১৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি ৩৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নে গড় অগ্রগতি ৮২ দশমিক ১১ শতাংশের নিচে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নিত এসব প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এগুলো যেহেতু কম গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিতই করা হয়েছে, সেহেতু এগুলো চলমান রাখার কোনো যুক্তি নেই। চলতে থাকলে কৃচ্ছ সাধানের উদ্যোগ কাজে আসবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, যেসব প্রকল্প ‘সি’ ক্যাটাগরির ছিল, সেগুলোর বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থনৈতিক ও জাতীয়ভাবে গুরুত্ব কম ছিল বলেই এগুলো ওই ক্যাটাগরির বলে চিহ্নিত করা হয়। এটা একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্প যদি আবার চলতেই থাকে, তাহলে এর পেছনে আরও বেশি অর্থ খরচ হতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃচ্ছ সাধনের উদ্যোগ কোনো কাজে লাগবে না। সামষ্টিক অর্থনীতির চাপে সরকার তখন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখনো বন্ধের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নজির স্থাপন করতে পারে। এসব প্রকল্প চলানো হলে কেন চালাতে হবে, এরও একটি নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল সরকারি তহবিলের ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। পুরো এক বছরে খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার ২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অব্যয়িত আছে ১৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যয় না হওয়ার নানা কারণ তুলে ধরা হলেও সবচেয়ে বেশি এসেছে কৃচ্ছ সাধনের বিষয়টি। এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৭টি প্রকল্পের মধ্যে দুটি ‘এ’, একটি ‘বি’ এবং চারটি ছিল ‘সি’ ক্যাটাগরিতে। এ কারণে সি ক্যাটাগরির প্রকল্পে অর্থ ব্যয় বন্ধ ছিল। সেই সঙ্গে কৃচ্ছ সাধনের ফলে কিছু খাতে ব্যয় সীমিত করায় অন্য ক্যাটাগরির প্রকল্পেও কম ব্যয় হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের আরএডিপিতে অর্থ ব্যয়ের হার মোট বরাদ্দের ৫৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো ‘বি’ ক্যাটাগরিভুক্ত ছিল। অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি অংশের অর্থ ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত ছিল। প্রশিক্ষণসহ কয়েকটি কোডে বরাদ্দ অর্থ ব্যয় কম হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের খরচের হার ৭৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। স্থানীয় সরকার বিভাগের খরচ হয়নি ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে কিছু অঙ্গের ব্যয় স্থগিত বা কমাতে হয়েছে। সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে দেয়। এটির অর্থ ব্যয়ের হার ৮১ দশমিক ০৯ শতাংশ। আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, কৃচ্ছ সাধনের কারণে প্রকল্পের কিছু অর্থনৈতিক কোর্ডে ৫০ শতাংশ অর্থ ব্যয় না করে সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এছাড়া পূর্ত কাজের ক্ষেত্রে নির্মাণসামগ্রীর বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে উন্নয়নকাজে গতি কম ছিল। এটির অর্থ ব্যয়ের হার ৭৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি। এর পেছনে ৫টি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে বিভিন্ন কোডে অর্থ খরচ সম্ভব হয়নি। এটির বরাদ্দ খরচের হার ৬৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
এ তালিকায় থাকা পুরো অর্থ খরচে ব্যর্থ হওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারেনি ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রায় ২ হাজার কোটি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ প্রায় ৫০০ কোটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রায় ৩০০ কোটি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরের হিসাবে এই টাকাটা বেঁচে গেছে বলা যায়। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর আবার সেসব খাতে ব্যয় করতে পারবে। এটা বাড়তি চাপ হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৃচ্ছ সাধনের কারণে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের মতো ব্যয়গুলো নিয়ন্ত্রিত ছিল। ফলে পরবর্তী সময়ে সেগুলো খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
