Logo
Logo
×

যেতে হবে বহুদূর

প্রত্যাশার আলোকে ডাক্তারদের সংবেদনশীলতা

Icon

ড. তৌফিক জোয়ার্দার

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের দেশে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আলোচনা ডাক্তারের আচরণগত দিক, তথা তাদের সংবেদনশীলতার অভাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগগুলো শোনা যায় সেগুলো হল : ডাক্তাররা সহানুভূতি নিয়ে রোগীদের গায়ে হাত দিতে চান না; রোগের ডায়াগনসিস, চিকিৎসাবিধি, আরোগ্যসম্ভাবনা, প্রতিকারের উপায়- এসব বিষয়ে রোগীকে ব্যাখ্যা দেননা; দৈনিক যে কয়টা রোগী তারা স্বাভাবিকভাবে দেখতে সক্ষম তারচেয়ে বহুগুণ বেশি রোগী তারা দেখে থাকেন; রোগীর রাজনৈতিক অবস্থান, ব্যক্তিগত পরিচয় ইত্যাদির ভিত্তিতে সেবা প্রদানে বৈষম্য করেন; অনেক সময় জরুরি পরিস্থিতি আমলে নিতে চান না; তারা সেবার চেয়ে ব্যবসার দিকটি বেশি গুরুত্ব দেন, বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে; নিজে রোগী যথাযথ চিকিৎসা করতে না পারলেও অন্য ডাক্তারের কাছে সহজে রেফার করতে চান না; অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দিয়ে নিজে লাভবান হন, যেমন : অযথা অ্যাপেন্ডিসেকটমি, সিজারিয়ান সেকশন ইত্যাদি করতে রোগীকে পরামর্শ দেন; সুনির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠিয়ে নিজেরা কমিশন নেন; সর্বোপরি, ওষুধ কোম্পানির বিপণন প্রতিনিধিদের সঙ্গে সন্দেহজনক লেনদেনে লিপ্ত হন। এ অভিযোগগুলো আমার নয়; তবে আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা আমার ডক্টরাল গবেষণার গুণগত সমীক্ষায় এ অভিযোগগুলোই রোগীদের কাছ থেকে উঠে এসেছে। নিজে একজন ডাক্তার হিসেবে জানি, এসব অভিযোগের অনেকই অমূলক নয়; তবে সব ডাক্তারই যে এসব করেন তা-ও নয়।

এর বাইরেও কিছু কিছু অভিযোগের খবর পত্রিকায় পড়ে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। এসবের মধ্যে পড়ে ডাক্তারের ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষণ পরই বাচ্চা মারা যাওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো রোগীকে দেখতে না যাওয়ার পরিণতিতে রোগীর মৃত্যু, সাধারণ জ্বরের রোগীকে ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি। চিকিৎসাবিদ্যা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে এমন মানুষও বুঝবেন যে এ অভিযোগগুলোর সত্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কারণ, ডাক্তাররাও আপনার-আমার মতো সাধারণ ঘরেরই ছেলেমেয়ে, যারা কয়েক বছর এক ধরনের বিশেষায়িত কিছু প্রতিষ্ঠানে (মেডিকেল কলেজ) পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছে। তারা পেশাদার খুনি নয়; ডাক্তারির ডিউটি সেরে তারাও বাসায় ফিরে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়, প্রেয়সীর সঙ্গে খুনসুটি করে, সন্তানের হাত ধরে হাঁটতে বের হয়, বিরানি খেয়ে ঢেঁকুর তোলে, বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা থাকলে উত্তেজনাভরে স্কোর দেখে; আপনার-আমার মতোই হাসে, কাঁদে, গান গায়, মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হয়। যে কোনো ওষুধের থেরাপিউটিক ইনডেক্স বলে একটি ভ্যালু থাকে। থেরাপিউটিক ইনডেক্স যত বেশি, সে ওষুধ বা ইনজেকশন তত নিরাপদ। আমার জানা মতে, এমন থেরাপিউটিক ইনডেক্সের ইনজেকশন খুব কমই আছে, যা পুশ করার সঙ্গে সঙ্গে, সেই ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়ায় বাচ্চা মারা যেতে পারে। এমন ওষুধ জেনেশুনে কোনো ডাক্তার কোনো শিশুকে দেবে একথা প্রায় অবিশ্বাস্য। জ্বরের রোগীকে ক্যান্সারের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা দিতে যাওয়ার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যাও আমার মাথায় আসছে না।

এ জাতীয় খবরগুলো সাংবাদিকরা পত্রিকায় লিখে থাকেন। মানুষ সেসব খবর আগ্রহ নিয়ে পড়েন এবং বিশ্বাসও করেন। যদিও এরকম খবরগুলোর সত্যতার সঙ্গে আমি পরিচিত নই। তবে এর মধ্যে একটি সত্যও কিন্তু আছে। সত্যটি হল- ডাক্তারের ব্যাপারে মানুষের অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইনজেকশন দিয়ে যে তারা অবলীলায় মানুষ মেরে ফেলতে পারে, এমন অবিশ্বাস্য একটি অভিযোগও এখন সাধারণ জনমানসে সত্য হওয়ার যোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। মেনে নিলাম ডাক্তার রোগী খুন করে না; কিন্তু নিশ্চয়ই সে এমন কিছু করে, যা তার প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে একজন খুনির কাতারে নামিয়ে এনেছে। আমি সাংবাদিক নই, তাই তারা কীভাবে বা কী নিয়ে রিপোর্টিং করবেন তা নিয়ে নসিহত করার এখতিয়ার হয়তো আমার নেই। সেটি করবেন অন্যান্য বিবেকবান ও সম্মানীয় সাংবাদিকরা। সাধারণ জনমানসের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস সারানোও সহজ নয়, তার প্রক্রিয়াও আমার জানা নেই। চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা করা একজন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাই পিএইচডির জন্য আমার নিজের পেশার মানুষদের সংবেদনশীলতার স্বরূপটি বোঝার চেষ্টা করেছি; এর সঙ্গে মানুষের মনে অবিশ্বাস জন্ম দেয়ার মতো কোনো অনুষঙ্গের যোগসূত্র আছে কিনা তা অনুসন্ধান করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটিই- ডাক্তাররা যেন আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে, রোগী তথা সাধারণ মানুষের মনে নিজেদের প্রতি বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে পারে।

যেহেতু ডাক্তারদের সংবেদনশীলতা নিয়ে এর আগে আর গবেষণা হয়নি, বিশেষ করে বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে, তাই প্রপঞ্চটিকে বোঝার জন্য গুণগত গবেষণা বা কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের শরণ নিতে হয়েছিল। ডাক্তারদের সংবেদনশীলতা কী, এর উপাদানগুলো কী কী, কোন গুণাবলিগুলো থাকলে একজন ডাক্তারকে সংবেদনশীল বলব- এসব প্রশ্নের সমাধান হওয়া প্রয়োজন; কারণ, ডাক্তারদের সংবেদনশীলতার সংজ্ঞায়ন আগে সেভাবে হয়নি। মেডিকেল এথিকস, হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে কিছু আলোচনা অতীতে হয়েছে; তার আলোকে এবং ২০০০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট ‘Health Systems: Improving Performance’ এ প্রদত্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংবেদনশীলতার সংজ্ঞার ভিত্তিতে ডাক্তারদের সংবেদনশীলতার সংজ্ঞায়ন করলাম, ‘রোগীদের ন্যায্য প্রত্যাশা পূরণে ডাক্তাররা যে সামাজিক কার্যসম্পাদন করেন’। এখানে উল্লেখ্য যে, ডাক্তারের কাছে রোগীর মৌলিক প্রত্যাশা থাকে যে, সে ডাক্তারের কাছ থেকে রোগের চিকিৎসা পাবে এবং সে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু, রোগীরা কোনো ইট-কাঠ-পাথরের তৈরি যন্ত্র নয়; তার একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে, সামাজিক জীব হিসেবে ডাক্তারের মুখোমুখি হয়। সামাজিক জীব হিসেবে, সুস্থ হয়ে উঠতে চাওয়ার পাশাপাশি তার আরও কিছু প্রত্যাশা ডাক্তারের কাছে থাকে। সে প্রত্যাশা করে ডাক্তার তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলবে, তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করবে, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, সময় নিয়ে ব্যবস্থাপত্রটি বুঝিয়ে দেবে, প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা রক্ষা করবে ইত্যাদি। কিন্তু তা-ই বলে প্রত্যাশাগুলো অন্যায্য বা ডাক্তারের বাস্তবতায় অসাধ্য হলেও চলবে না। কাজেই আমাদের কেবল রোগী কী চায় তা জানলেই চলবে না; এ বিষয়ে ডাক্তাররা কী ভাবছে তা-ও জানা চাই। তাই খুলনা বিভাগের একটি জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে আমি রোগীদের কাছ থেকে একান্ত সাক্ষাৎকার ও দলীয় আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করলাম। সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে কর্মরত ডাক্তারদেরও একান্ত সাক্ষাৎকার নিলাম। শুধু তা-ই নয়; রোগীদের অভিযোগ ও চাহিদা এবং ডাক্তারদের দাবিকে বাংলাদেশের বাস্তবতার সাপেক্ষে যাচাই করে নেয়ার স্বার্থে দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ ডাক্তারদের পরামর্শ কক্ষে নিরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ করে কাটালাম।

কোয়ালিটেটিভ গবেষণার ধাপগুলো অনুসরণ করে আমি যে ফলাফল পেলাম, তার আলোকে ডাক্তারদের সংবেদনশীলতাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করা চলে: ১) বন্ধুসুলভতা: এর মধ্যে পড়ে- অভিবাদন জানানো (greetings), রোগীর কাছে নিজের পরিচয় দেয়া, কিছু সামাজিক কথোপকথন করা, বন্ধুর মতো আচরণ করা, তাকে আশ্বস্ত করা, পেশাগত শব্দ ব্যবহার না করে সহজ ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলা, নিজেকে খুব বড় বলে জাহির না করা, কথোপকথনের বাইরেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা (non-verbal communication), কিছু হাস্যরস করা এবং পরামর্শ শেষে বিদায় জানানো। ২) শ্রদ্ধাশীলতা : এর মধ্যে পড়ে- রোগীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, তাদের অভিযোগ মনোযোগের সঙ্গে ও পরিপূর্ণভাবে শোনা, সম্মতি নেয়া, রোগীকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া, সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল হওয়া, আর্থসামাজিক অবস্থান-লিঙ্গ-ধর্ম-রোগের ধরন বা অন্য যে কোনো বিষয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য প্রদর্শন না করা, পরামর্শের সময় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকা, পোশাক-আশাকে শালীনতা ও ভদ্রতা বজায় রাখা, পরামর্শ কক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। ৩) তথ্য প্রদান ও দিকনির্দেশনা : এর মধ্যে পড়ে- নিজের সীমাবদ্ধতার কথা আগেই রোগীকে অবহিত করা, রোগীদের উপযুক্ত চিকিৎসক খুঁজে পেতে সাহায্য করা, রোগের কারণ নাম (ডায়াগনসিস)-আরোগ্যসম্ভাবনা-চিকিৎসা-প্রতিরোধে করণীয়-ওষুধের প্রতিক্রিয়া-টেস্টের ফলাফল রোগীকে বিশদ ব্যাখ্যা করা, রোগীকে চিকিৎসাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সেবাদানে অংশীদার করা, রোগ-প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে তথ্য দেয়া, এমনভাবে ব্যবস্থাপত্র লেখা যাতে রোগী সহজে বুঝতে পারে (তথা হাতের লেখা পাঠ অনুকূল হওয়া), রোগী যেন সহজে ফলোআপ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। ৪) আস্থা অর্জন : এর মধ্যে পড়ে- রোগীর দেয়া তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা, দরকার পড়লে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে উপযুক্ত স্থানে রেফার করে দেয়া, কোনো বিষয়ে নিজের সন্দেহ থাকলে সেক্ষেত্রে অন্য সহকর্মীর মতামত নেয়া, রোগীর বিশ্বাস অর্জনে সচেষ্ট হওয়া, ব্যবসায়িক মানসিকতা পরিহার করে সেবামুখী হওয়া, সব ধরনের অবৈধ ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা। ৫) রোগীর কল্যাণ সর্বোচ্চীকরণ : এর মধ্যে পড়ে- চিকিৎসার স্বার্থে প্রয়োজন হলে রোগীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেয়া, প্রয়োজন হলে রোগীর বাসায় গিয়ে সেবা দেয়া, রোগীর বিশেষায়িত চাহিদাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া, রোগী তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে যেন সুবিধা পেতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করা, অর্থনৈতিক সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করা।

বলাই বাহুল্য এগুলো একটি আইডিয়াল বা আদর্শ প্রত্যাশা; বাস্তবতার নিরিখে এর সবকিছু একসঙ্গে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়- কেবল ডাক্তারের দোষে নয়, সম্ভব নয়, কারণ এর সবকিছুর জন্য এমনকি আমাদের রোগীরাও প্রস্তুত নয়। সর্বোপরি ডাক্তারদের সংবেদনশীল হওয়ার পথটি সুগম করার জন্য একটি সুষ্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যা যা থাকা অপরিহার্য, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তার মর্মান্তিক ঘাটতি রয়েছে। তাই সব দোষ নন্দ ঘোষ ডাক্তারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও অন্যায় করা হবে। যেসব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ডাক্তারদের সংবেদনশীলতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করেছেন, এমনকি অনেক ডাক্তার এটিকে ক্লিনিক্যাল কমপিটেন্সি তথা আসল চিকিৎসার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত একজন বয়স্ক ডাক্তার যেমনটি বলেছেন, ‘একজন রোগী যদি ডাক্তারের কাছে থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা পায়, মিষ্ট ওষুধও তাকে সন্তুষ্ট করবে না’। অনেক ডাক্তারই নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন, তার পেছনের কারণগুলোও উল্লেখ করতে ভুলেননি। যেমন, তারা স্বীকার করেছেন যে তারা রোগীদের বেশি সময় দিতে পারেন না, কাউন্সেলিংয়ের কথা চিন্তাও করতে পারেন না; কিন্তু তারা এর জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারের স্বল্পতাকে দায়ী করেছেন। তারা স্বীকার করেছেন যে অনেক সময়ই তারা রোগীদের ‘অপ্রাসঙ্গিক’ প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হন, তবে এর জন্য অনেক সময় রোগীর চেয়েও রোগীদের সঙ্গে আসা মানুষজন বেশি দায়ী থাকে। তারা আরও বলেছেন, তারা অনেক সময়ই উপযুক্তভাবে রোগীদের গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন না, রোগীদের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হন; তবে তার জন্য দায়ী করেছেন পৃথক পরীক্ষা কক্ষ, পর্দা ইত্যাদির অভাবকে। তারা এ-ও স্বীকার করেছেন, অনেক ডাক্তারই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সত্ত্বেও নিজেদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখতে বেশি উৎসাহিত বোধ করেন।

আমার গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাক্তাররা গড়ে রোগীপ্রতি চার মিনিট সময় দেন, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দেন ছয় মিনিট। আরেকটি সীমাবদ্ধতার কথা প্রায় সব ডাক্তারই উল্লেখ করেছেন; তা হল, আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় context specific সংবেদনশীলতা বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

রোগীরাও যে অনেক সময় ডাক্তারদের সংবেদনশীলতা প্রকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তা-ও দেখেছি। যেমন, অনেক রোগীই লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সেবা নিতে চাননা, ডাক্তারের রুমের সামনে ধৈর্য ধরে না দাঁড়িয়ে অন্য রোগী থাকা অবস্থায় ডাক্তারের চেম্বারের ভেতরে ঢুকে বসে থাকতে পছন্দ করেন। এ দৃশ্য শহরাঞ্চলে বিশেষ দেখা না গেলেও, গ্রামাঞ্চলে এটিই সাধারণ্যে আচরিত। ডাক্তার নিষেধ করলেও রোগীরা তা শুনতে চাননা, এমনকি মারমুখীও হয়ে ওঠেন। সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ পরিস্থিতি আরও অসহনীয়, যেখানে ডাক্তারের করণীয়ই বা কী? আর কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা সরকারি-বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তি আসলে তাকে লাইনে দাঁড়াতে অনুরোধ করলে ডাক্তারকে হতে হয় অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন। সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগটি ডাক্তারদের কাছ থেকে শুনেছি তা হল ফেইক পেশেন্ট বা ভুয়া রোগী সংক্রান্ত। ২০০৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন করা তুলনামূলকভাবে নতুন একজন সরকারি ডাক্তার বলছিলেন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি যেভাবে রোগী দেখা উচিত সেভাবে দেখার জন্য; কিন্তু আমার এত লোড থাকে যে আমি তা পারি না। রোগী আসার পর প্রথমে আমরা তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করি যে সে ফ্রি ওষুধ নিতে এসেছে নাকি চিকিৎসা নিতে এসেছে। আমাদের বেশিরভাগ রোগীই এখানে ফ্রি ওষুধ নিতে আসে। আমি যখন চিন্তা করি যেহেতু আমার রুমের সামনে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ লোকের একটা লাইন থাকে, তখুনি আমার মাথায় ঢুকে যায় যে, এ ওষুধ নিতে এসেছে; এ যা বলছে বলুক, আমি লিখতে থাকি। এত লোকের ভিড় দেখে, তার মাঝে এত ভুয়া রোগী দেখে, রোগীদের সঙ্গে আর ভালো ব্যবহারের ধৈর্য থাকে না’।

এ নিবন্ধে আমি ডাক্তারদের সংবেদনশীলতার পাঁচটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছি। এ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই রয়েছে রোগীদের নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা; যা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে এ অভিজ্ঞতা ও আমার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমি তিনটি সাধারণ অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি: ১) সংবেদনশীলতার সংজ্ঞায়ন ও এর উপাদানগুলোর ব্যাপারে, আরও সহজ ভাবে বলতে গেলে- ডাক্তারের কাছ থেকে রোগীদের প্রত্যাশা কী হতে পারে তার ব্যাপারে রোগী ও ডাক্তারের ধারণার মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। ২) ডাক্তারদের সংবেদনশীলতাকে বুঝতে গেলে তাদের বাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতার বিষয়টিও মাথার রাখতে হবে; একতরফা ভাবে ডাক্তারদের দোষারোপ করাটা অন্যায় হবে। ৩) আমরা যদিও সমালোচনাটা বেশি করতে পছন্দ করি; কিন্তু যেখানে প্রশংসা প্রাপ্য সেখানে প্রশংসা করতে কার্পণ্য দেখাই। ডাক্তারদের পজিটিভ দিকও অনেক আছে; সেগুলোকে স্বীকৃতি দিলে ডাক্তার ও রোগী উভয়েরই উপকারের সম্ভাবনা আছে। গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই: ডাক্তারদের সংবেদনশীলতার ওপর আরও বেশি প্রসঙ্গ-নির্দিষ্ট গবেষণা হওয়া জরুরি। দেশীয় সংস্কৃতির আলোকে সম্পাদিত গবেষণার ভিত্তিতে ডাক্তারদের শিক্ষাজীবন থেকেই প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে, যেন তারা দেশের মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে। শুধু শিক্ষাজীবনেই নয়, ইন্টার্নশিপ ট্রেনিং ও ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ে সংবেদনশীলতার ওপর প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর এসব প্রশিক্ষণের ভিত্তি হতে হবে কোনো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আলোকে লিখিত পুস্তক নয়, বরং দেশীয় কনট্ক্সেট ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে পরিচালিত গবেষণা।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম